শ্রীলঙ্কার সেই ঋণের পুরোটাই ফেরত পেল বাংলাদেশ

শ্রীলঙ্কার সেই ঋণের পুরোটাই ফেরত পেল বাংলাদেশ

এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশকে ১০ কোটি ডলার ফেরত দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তার আগে ১৭ আগস্ট প্রথম কিস্তিতে ৫ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল দেশটি।

শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া সেই ২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের পুরোটাই ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বৃহস্পতিবার ঋণের শেষ কিস্তির ৫ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা।

শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক এআরএইচ ডটকমকে এই তথ্য জানিয়েছেন। 

তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কা শেষ কিস্তির ৫ কোটি ডলার ও ঋণের সুদ বাবদ ৪৫ লাখ ডলার বৃহস্পতিবার রাতে পরিশোধ করেছে। আমরা শুক্রবার সকালে বিষয়টি জেনেছি।” 

এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশকে ১০ কোটি ডলার ফেরত দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তার আগে ১৭ আগস্ট প্রথম কিস্তিতে ৫ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল দেশটি। 

চরম আর্থিক সংকটে পড়ে রিজার্ভ তলানিতে নেমে আসায় দুই বছর আগে বাংলাদেশের কাছে ঋণ চেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সে সময় শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছিল; রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। 

সংকট কাটিয়ে এখন শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। শোধ করে দিচ্ছে সেই ঋণ। তারই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার শেষ কিস্তি পরিশোধ করেছে দেশটি। 

২০২১ সালের মে মাসে এক বছর মেয়াদে এ ঋণ নিয়েছিল দেশটি। তবে গত বছর অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হলে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কা। সে কারণে কয়েকবার ঋণ পরিশোধে সময় নেয় তারা। চলতি বছর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। 

চুক্তি অনুযায়ী, ঋণের বিপরীতে শ্রীলঙ্কা লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফার রেট (লাইবর) এর পাশাপাশি বাংলাদেশকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ সুদ প্রদান করার কথা ছিল।

  

বিদেশি মুদ্রার সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কাকে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় ২০২১ সালের আগস্ট-অক্টোবর সময়ে চার কিস্তিতে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ।  

ওই বছরের ১৮ আগস্ট প্রথম কিস্তির ৫ কোটি ডলার ছাড় করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই ঋণ ছাড়ের মাধ্যমে ঋণদাতা দেশের তালিকায় নাম লেখায় বাংলাদেশ। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই ঋণ দেওয়া হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল (গ্রস হিসাাবে) ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি।  

শ্রীলঙ্কার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তাদের ঋণ দেওয়ার নীতিগত অনুমোদন হয়। এরপর চুক্তিনামা তৈরিসহ কিছু প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে।  

যেসব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কম তারা বিপদে পড়লে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ নেয়।  

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়। তবে শ্রীলঙ্কার ওই মুহূর্তে সেটি ছিল না।  

ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ কমতে কমতে একেবারে তলানিতে নেমে এসেছিল। দুই সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভও ছিল না।  

সংকট মেটাতে বন্ধুপ্রতীম দেশ বাংলাদেশের কাছ থেকে ঋণ চেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিল।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতির কারণে দ্বীপরাষ্ট্রটি ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার জন্য আলোচনা করছে।

আইএমএফের বেলআউটের জন্য অপরিহার্য হলো বহিরাগত ঋণ পুনর্গঠন করা, যা সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।  

এদিকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দেশটির মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। দুই বছরের মধ্যে প্রথমবার দেশটির মূল্যস্ফীতি এক অংকের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট)  নেমেছে।   

পর্যটন ও রেমিটেন্স থেকে আসা ডলারের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। বিষয়টি ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে আইএমএফের বেলআউট পেতে দেশটিকে সহায়তা করবে আশা করা হচ্ছে।  

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত ব্যাপক ক্ষতিতে পড়েছিল। বৈদেশিক বিনিময়ে প্রতিনিয়ত মান হারাতে শুরু করে দেশটির মুদ্রা রুপি।  

এতে টান পড়ে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতে। এমন পরিস্থিতিতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ডলার ধার করে শ্রীলঙ্কা। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারও ২০ কোটি ডলার ঋণ দেয় দেশটিকে। 

‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০২১ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে।  

ওই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ডব্লিউ ডি লক্ষ্মণ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে ডলার চেয়ে চিঠি দেন। এরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ধার বা ঋণ হিসেবে নয়, বরং ডলারের সঙ্গে শ্রীলঙ্কান রুপি অদলবদল বা সোয়াপ করেই তা দেওয়া হয়।

 

বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন বেশ চাপে 

এদিকে সংকট কাটাতে শ্রীলঙ্কাকে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার দিয়ে সহায়তা করেছিল যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের রিজার্ভই এখন বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। 

শ্রীলঙ্কা এমন সময়ে ঋণ পরিশোধ করল, যখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। ফলে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমছেই। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৭ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে।  

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার।  

গত ৫ সেপ্টেম্বর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৯ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।  

৭ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে। 

গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

ওই দিন ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।  

এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত দুই মাস সাত দিনে ‘গ্রস’ রিজার্ভ কমেছে ২ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। 

সবশেষ গত জুলাই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে চার মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।   

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

রিজার্ভ কমছেই, ২ মাসে নেই ২.৬৪ বিলিয়ন ডলার পরবর্তী

রিজার্ভ কমছেই, ২ মাসে নেই ২.৬৪ বিলিয়ন ডলার

কমেন্ট