‘নির্বাচনের আগে রিজার্ভ যেন ১৫ বিলিয়নের নিচে না নামে’
সোমবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত 'দক্ষিণ এশিয়ায় আর্থিক চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব বলেন। ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নির্বাচনের আগে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ যেন কোনো অবস্থাতেই ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে না নামে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেছেন, “বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে রিজার্ভ। এই সূচক অনেক কমেছে। আর কমতে দেওয়া যাবে না। রিজর্ভ ধরে রাখতে অবশ্যই আইএমএফের থেকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ-সহায়তা পাওয়াসহ সম্ভাব্য সব বিকল্পের খোঁজ করতে হবে।”
রিজার্ভ যেনো আর না কমে, সেজন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে জরুরিভিত্তিতে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
সোমবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত 'দক্ষিণ এশিয়ায় আর্থিক চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব বলেন।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের সঞ্চালনায় সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার সামির সাত্তার।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রানজিস্কা লিসেলোট ওহনসোর্জ।
সেমিনারে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর বলেন, “দেশের সামনে একটি নির্বাচন আছে এবং এটি স্বাভাবিক নির্বাচন নয়, কারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগামী দিনগুলোতে অনেক অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।”
“এখন আমাদের জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। রাজস্ব বাড়াতে হবে। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করতে হবে।”
আহসান মনসুর বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। দেশের অর্থনীতির এই সংকটময় পরিস্থিতিতে নেই কোনো স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বা কার্যকর রাজনৈতিক ভূমিকা। যেটা অনেক আগে নেওয়া উচিত ছিল। বিশেষ করে আর্থিক খাতের সংস্কার করা উচিত ছিল আরও আগে।”
“অনেকে বলছেন দেশের অর্থনৈতিক সংকট বৈশ্বিক কারণে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে। আসলে বিষয়টি তা নয়। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ কারণে এ সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময় বলেছেন আমরা ভালো করছি। আমাদের অর্থনীতি ভালো করছে। হ্যাঁ, আমরা ভালো করছিলাম। কিন্তু যখন পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেল তখন আমরা সমস্যা সমাধানের জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপ নেইনি।”
জিডিপি অনুপাত অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েও রাজস্ব বাড়ানো যাচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয় তার চেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ হয় দক্ষিণ আফ্রিকাতে।
“করোনার সময় আমরা আমাদের খরচ কমাতে পেরেছি; কিন্তু আয় বাড়াতে পারিনি। এখন আমাদের আয় বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে রাজস্ব আহরণ বাড়তেই হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের বৈদেশিক ঋণ এখনও স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে আছে তা ঠিক। কিন্তু ইতোমধ্যে বেশকিছু ঋণ পরিশোধের সময় হয়ে গেছে। দিন যত যাবে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। সেই চাপ মোকাবিলায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার। আর গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার।
তার আগের সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৭ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারে।
এ হিসাবে এক সপ্তাহে বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ১০ কোটি ডলার। আর ‘গ্রস’হিসাবে কমেছে ১৯ কোটি ডলার।
১৪ সেপ্টেম্বর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার।
গত ৫ সেপ্টেম্বর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৯ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।
৭ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে।
গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ওই দিন ‘গ্রস’রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত তিন মাসে ‘গ্রস’রিজার্ভ কমেছে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে কমেছে আড়াই বিলিয়ন ডলার।
সবশেষ গত জুলাই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
তবে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের কম।
গত বুধবার ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের (আইবিএফবি) বার্ষিক সম্মেলনে এ তথ্য দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, “দেশে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ঢুকছে এবং যা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার প্রকৃত হিসাব মিলছে না। ব্যালান্স অব পেমেন্টে বা লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার নিট মজুত কমে ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।"
সোমবারের সেমিনারে সেলিম রায়হান বলেন, এখনই সরকারকে অর্থনীতির ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তা বিবেচনায় স্বল্পমেয়াদে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। যখন আমাদের দেশে অর্থনীতিতে সুসময় চলছিল তখনও এই সমস্যাগুলো চলছিল।
“কিন্তু তখন আমরা সে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারিনি। কোনো পদক্ষেপও নেইনি। এখন আমাদের রিজার্ভ এবং প্রবাসী আয় কমেছে। এখনই সমস্যাগুলো সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে।”
আইএমএফের শর্তের প্রসঙ্গ টেনে সেলিম রায়হান বলেন, “এসব শর্তের কথা আমরাও অনেক আগে থেকে বলে আসছিলাম। আগামী ২ থেকে ৩ বছর আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন যদি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে অর্থনৈতিক সংকট কাটানো সম্ভব।”
এছাড়া মধ্য আয়ের ফাঁদে বাংলাদেশের পড়ার শঙ্কা আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সামির সাত্তার বলেন, নিবার্চন পরবর্তী যে সরকার আসুক না কেন, অর্থনীতির জন্য বেশকিছু খাতে সংস্কার এখন জরুরি। আমাদের এখন সরকারি অর্থ খরচের বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প নিতে হবে। সরকারি অর্থ খরচে সতর্কতা নিতে হবে। যাতে অপচয় না হয়।
ফ্রানজিসকা রিসিলোটি ওহানসোরোজ বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। রাজস্ব আহরণ থেকে শুরু করে আর্থিক খাতে দ্রুত সংস্কার করতে হবে।
কমেন্ট