রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমাতে রাজি হয়েছে আইএমএফ
আইএমএফ ফরেক্স রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে—২০২৪ সালের জুন নাগাদ ২০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার রাখার নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেবে।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক এখন বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। বহুল আলোচিত ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের শর্তে কোন সময়ে বাংলাদেশে কত রিজার্ভ থাকতে হবে—তার একটি লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল আইএমএফ।
বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে সেই লক্ষ্য কমাতে রাজি হয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি। সেইসঙ্গে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার শর্তও কমাতে রাজি হয়েছে আইএমএফ।
৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্যাকেজের আওতায় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বেশ কিছু শর্ত পূরণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। এর মধ্যে প্রধান দুটি শর্ত ছিল বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক রিজার্ভ এবং রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে।
আগামী দিনগুলোতে কোন সময়ে দেশে কত রিজার্ভ থাকতে হবে; কী পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে হবে—তার একটি লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছিল আইএমএফ। এ সব লক্ষ্য পূরণ না হলে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা এই সংস্থাটির সব কিস্তির ঋণ নাও পাওয়া যেতে পারে বলে সমঝোতা চুক্তিতে উল্লেখ ছিল।
বাংলাদেশের জন্য গত ৩০ জানুয়ারি বহুল আলোচিত ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে আইএমএফ। ৭ কিস্তির প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করা হয় ফেব্রুয়ারিতে। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার কথা আগামী নভেম্বর মাসে। দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ দেওয়ার আগে প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড়ের মূল্যায়ন করতে আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এখন ঢাকায় অবস্থান করছে।
প্রায় প্রতিদিনই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা অর্থমন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকস, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী গত জুনে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ২ হাজার ৪৪৬ কোটি (২৪.৪৬ বিলিয়ন) ডলার। তবে এ শর্ত পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরের লক্ষ্য ছিল ২ হাজার ৫৩০ কোটি (২৫.৩০ বিলিয়ন) ডলার। এটিও পূরণ হয়নি।
ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ কোটি (২৬.৮০ বিলিয়ন) ডলার রিজার্ভ থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশ এই শর্তও পূরণ করতে পারবে না বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক এর আগে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেছিলেন, আইএমএফের বেশ কিছু শর্ত পূরণ করা হলেও কিছু ব্যর্থতা আছে। যেমন রিজার্ভ কিছু কম আছে। রাজস্ব আহরণও কম।
“বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণেই এটা হয়েছে। আইএমএফ নিশ্চয় এই বিষয়টি বুঝতে পারছে।”
মোট রিজার্ভ, ব্যালান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ৬ (বিপিএম ৬) ও প্রকৃত রিজার্ভ—বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের এ তিন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আইএমএফের ঋণ নেওয়ার পর কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক মোট রিজার্ভ ও বিপিএম ৬ পদ্ধতির হিসাব প্রকাশ করে আসছে।
তবে জনসমক্ষে প্রকৃত বা নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদিও প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য আইএমএফকে জানাচ্ছে।
গত জুনে দেশের মোট রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী তা ছিল ২ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার।
একইভাবে গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মোট রিজার্ভ ২ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার থাকলেও বিপিএম ৬ অনুযায়ী ছিল ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানায়, দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৭০০ কোটি বা ১৭ বিলিয়ন ডলারের মতো।
তবে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এরপর দুই বছরে প্রতি মাসেই রিজার্ভ গড়ে ১০০ কোটি ডলার করে কমেছে।
রিজার্ভ নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা সম্প্রতি যেসব কথা বলেছেন, তার মধ্যে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ।
৯ অক্টোবর তিনি ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক অনুষ্ঠানে বলেন, “এখন বাংলাদেশ ব্যাংকই বলছে, প্রকৃত রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। এ রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে যদি ১০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, তাহলে এমন হতে পারে যে আইএমএফের ঋণ পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের রিজার্ভ যেভাবে ধারাবাহিকভাবে কমছে, তার সঙ্গে তিনি শ্রীলঙ্কার মিল খুঁজে পান বলে জানান রেহমান সোবহান।
রিজার্ভের নতুন লক্ষ্যমাত্রা
সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনায় জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, আইএমএফ ফরেক্স রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে—২০২৪ সালের জুন নাগাদ ২০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার রাখার নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেবে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথমসারির পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ যখন পশ্চিমা দেশগুলোয় চাহিদা কমে যাওয়ার সম্মুখীন; মূল্যস্ফীতি ও সার, জ্বালানি ও শিল্প কাঁচামাল আমদানির উচ্চ ব্যয় যখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে–তারমধ্যেই আইএমএফের সাথে আলোচনায় এ অগ্রগতি এলো।
আলোচিত এসব চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় হয়েছে এবং দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশি টাকার ৩৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটেছে।
মঙ্গলবার সফররত আইএমএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে অংশ নেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বৈঠকে আইএমএফ কর্মকর্তারা চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারকে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল, সেটিও কমাতে রাজি হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
চলতি বছরের শুরুতে আইএমএফ সেপ্টেম্বর নাগাদ ২৫ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু আইএমএফের রিজার্ভ হিসাব করার পদ্ধতির ষষ্ঠ সংস্করণ বিপিএম৬ অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২১ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলার।
নিট হিসাব করলে এর পরিমাণ আরও কমে ১৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, “আগামী বছরের জুন নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার রাখার শর্ত দিয়েছিলো আইএমএফ। আগের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে তা থেকে কমিয়ে জুন নাগাদ তা ২০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার করার বিষয়ে রাজি হয়েছে আইএমএফ।”
এই সংশোধন বাংলাদেশের জন্য বড় স্বস্তি হয়ে এলো বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
গত ৪ অক্টোবর ঢাকায় আসেন আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। ১৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাবে।
সফর শেষ হওয়ার শেষদিনে এসব আলোচনার ফলাফল জানাবেন আইএমএফ মিশনের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে বৃহস্পতিবার একটি সংবাদ সম্মেলন করবেন তারা।
মঙ্গলবার আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের আগে অর্থ সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার যেসব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে আইএমএফের শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে তাদের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন।
ওই বৈঠকে আগামী জুনের মধ্যে সংস্থাগুলো তাদের সংশ্লিষ্ট টার্গেট কতটা অর্জন করতে পারবে, তা জানতে চান অর্থ সচিব। সংস্থাগুলোর মতামত নিয়ে দুপুরে আইএমএফ মিশনের সাথে বৈঠকে অংশ নেন অর্থ সচিব। বৈঠকে রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় এই সিদ্ধান্ত হয়।
আইএমএফ মিশনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, জরুরি আমদানির ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বিবেচনায় আগামী বছরের জুন নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের (রিজার্ভ) লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
তার পরিপ্রেক্ষিতে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমাতে সম্মতি দেয় আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
রাজস্বের নতুন লক্ষ্যমাত্রা
ঋণ কর্মসূচির একটি শর্ত হিসেবে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ লাখ ১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল আইএমএফ।
কিন্তু আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনী বছরে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপর আইএমএফ এই লক্ষ্য কমিয়ে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যদিও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন, সংশোধিত এই লক্ষ্য অর্জনও কঠিন হবে। কারণ আমদানি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার সুযোগ কম। আবার কর ছাড়ও কমানো যাবে না। ফলে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহে বড় ধরনের উলম্ফন সম্ভব না।
গত অর্থবছরে এনবিআর আইএমএফ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় করেছে। তাই চলতি অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে।
কমেন্ট