৪ মাসে রিজার্ভ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি
গত বৃহস্পতিবারও ৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চার মাস ২ দিনে (১ জুলাই থেকে ২ নভেম্বর) ৪৫৩ কোটি (৪.৫৩ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চাহিদার কারণে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এই অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবারও ৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চার মাস ২ দিনে (১ জুলাই থেকে ২ নভেম্বর) ৪৫৩ কোটি (৪.৫৩ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিক্রি করা হয় ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আগস্টে বিক্রি করা হয়েছে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরে বিক্রি করা হয়েছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
আর ১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে ৭৮ কোটি ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই চার মাসে (১ জুলাই থেকে ২ নভেম্বর) রিজার্ভ থেকে ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল।
জ্বালানি তেল, সারসহ সরকারি কেনাকাটায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে এই ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রিজার্ভ থেকে এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রোববার আন্তঃব্যাংকে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১১ টাকা।
আগে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের চেয়ে ২/৩ টাকা কম দামে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত জুলাই থেকে আর কম দামে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না।
তবে সব ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে না। সরকারের প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্য ব্যাংকগুলোকে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক এখন রিজার্ভ। এই রিজার্ভ কমতে কমতে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। আর এর জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি একটি কারণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) বিক্রি করা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
করোনা মহামারির কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
সব ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সঞ্চিত রিজার্ভ আরও কমে যাবে। সেজন্য সরকারের প্রয়োজনেই শুধু রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড়া হচ্ছে।
আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতেও নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে; তার পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না।
সবশেষ গত বৃহস্পতিবার রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওইদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারে।
২০২১ সালের আগস্টে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
দু-এক দিনের মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে বলে হিসাব দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
গত ১২ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ওই দিন ‘গ্রস’রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত চার মাসে ‘গ্রস’ রিজার্ভ কমেছে ৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে কমেছে ২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
সবশেষ গত আগস্ট মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়।
পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর।
এর পর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সব দেশেই পড়েছে। সব দেশেই ডলারের দর বেড়েছে; মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। সামাল দিয়ে তারা কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব দেশেই মূল্যস্ফীতি কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে উঠে গিয়েছিল; এখন ৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে তারা।
“কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি কমছে না। ডলার সংকট কাটছে না; ডলারের বাজারে অস্থিরতা যাচ্ছে না। অক্টোবরে রেমিটেন্স বাড়লেও রপ্তানি আয় বেশ কমেছে; রিজার্ভ কমছেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে—সব দেশ পারলে আমরা পারছি না কেনো? আমাদের গলদ কোথায়? আমরা কী ঠিকঠাক মত ব্যবস্থাপনা করছি না।?”
“এখানে দুটি বিষয় আমি পরিস্কারভাবে উল্লেখ করতে চাই। দীর্ঘদিন ডলারের দর ধরে রেখে আমরা ঠিক কাজটি করিনি। ওইটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত।
আরেকটি ভুল ছিল আমাদের- মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল; তারপরও আমরা ৯ শতাংশ সুদ হার দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলাম। এখন অবশ্য সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই দুই ভুলের মাশুলই আমাদের এখন দিতে হচ্ছে। আরও কতদিন দিতে হবে কে জানে?”
“কতদিন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হবে, তাও কিছু বলা যাচ্ছে না।”
কমেন্ট