এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ৯ বিলিয়ন ডলার

এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ৯ বিলিয়ন ডলার

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমেছেই। গত বছরের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ৩৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। কমতে কমতে বৃহস্পতিবার তা ২৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক কমেছে ৯ বিলিয়ন ডলার।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাশপাশি রিজার্ভের এই তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার এই তথ্য প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ‘গ্রস’ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। ওইদিন আইএমএফ হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।

গত ৮ নভেম্বর ওই রিজার্ভ থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়। ৯ নভেম্বর নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে আকুর ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে। বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ নামে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।

সবশেষ বৃহস্পতিবার ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬ হিসাবে ছিল ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। ওই বছরের ২৪ আগস্ট রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।

এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে। এক বছর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর রিজার্ভ ছিল ৩৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে রিজার্ভ কমেছে ১৪ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার।

সবশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বিপিএম৬ হিসাবের ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। তার আগে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) নিম্মমূখী।

এ পরিস্থিতিতে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ না পাওয়া পর্যন্ত রিজার্ভ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর আকুর দেনা পরিশোধ করা হয়। জুলাই-অগাস্ট মেয়াদের ওই বিল ছিল এক দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার।

আমদানির লাগাম টেনে ধরতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় এবার আকুর বিল আগের চেয়ে একটু কমেছে।

গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওই দিন ‘গ্রস’রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, দুই পদ্ধতিতে রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করার পর গত চার মাসে বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৪ বিলিয়ন ডলার।

আমদানি ব্যয়ে ধারগতির পরও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে। প্রবাসীদের পাঠানো রপ্তানি আয়ে ধস এবং জ্বালানি তেল, সার, খাদ্যপণ্যসহ সরকারের অন্যান্য আমদানি খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণেই রিজার্ভ কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স। অক্টোবরে মাসে রপ্তানি আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এই মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়লেও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে রেমিটেন্স কমেছে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।

মহাসংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কা অবশ্য আকু থেকে বেরিয়ে এসেছে।

রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে কিন্তু চার মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আমদানি বেড়ে যদি ৬ বিলিয়ন হয়, তাহলে কিন্তু ৩ মাসের কিছু বেশি সময়ের খরচ মিটবে। তার মানে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।।”

“রিজার্ভ যেনো আর না কমে—সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমরা বার বার সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিলাম। গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেও অনুরোধ করেছিলাম।”

“কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। রিজার্ভ কমছেই। প্রকৃত রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলার নামা কিন্তু একটি স্পর্শকাতর মানদণ্ড।”

দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাব করতে বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিল।

কিন্তু বাংলাদেশ সে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।

ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।

বাাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের সেই শর্ত বা পরামর্শ মেনেই এখন রিজার্ভের দুই ধরনের তথ্যই প্রকাশ করছে।

১৯ বিলিয়নের ঘরে নেমে এলো রিজার্ভ পরবর্তী

১৯ বিলিয়নের ঘরে নেমে এলো রিজার্ভ

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর