রিজার্ভ বাড়ছেই, ১ সপ্তাহেই বাড়ল ৮০ কোটি ডলার
বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর। অর্থনীতির যে সূচক নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আলোচনা ছিল—সেই সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়ছেই। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রিজার্ভ বেড়েছে ৮০ কোটি ডলার। আর এতে জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে স্বস্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ২১ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৭৭ কোটি ডলার। আর ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ৭৮ কোটি ডলার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের বহুল প্রতিক্ষিত দ্বিতীয় কিস্তি ৬৯ কোটি ডলার, ম্যালিাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৪০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৯ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ডলার কেনার ফলে রিজার্ভ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার ইসলামী ব্যাংক থেকে ২০ কোটি ডলার কিনে রিজার্ভে যোগ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বাইরেও অন্যন্য ব্যাংক থেকেও গত এক সপ্তাহে আরও ১০ কোটি ডলারের বেশি কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মেজবাউল হক এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়ত ব্যাংকগুলোকে ডলার সাপোর্ট দিচ্ছি। আবার কিছু ব্যাংক থেকে ডলার কিনছি। চলতি সপ্তাহে কয়েকটি ব্যাংক থেকেই ডলার কেনা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও আরও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ডলার কেনা হয়েছে।”
“বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের বেশি ডলার রয়েছে; তাই তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ গত অক্টোবর মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৫২বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আইএমএফ, এডিবি ও দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণ যোগ হওয়ার আগে গত ১৩ ডিসেম্বর ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, রেমিটেন্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ডলারের দর ১ টাকা কমেছে। আরও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
“সব মিলিয়ে রিজার্ভ বাড়ছেই। আর এতে ডলার সংকট অনেকটাই কেটে যাবে; অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে।”
“অক্টোবর, নভেম্বরের মতো চলতি ডিসেম্বর মাসেও রেমিটেন্সসহ ডলার আসার প্রবাহ ইতিবাচক রয়েছে। সঙ্গে দাতা সংস্থার ঋণ যোগ হচ্ছে। কিছু খরচ হবে, তবে আয়ের চেয়ে ব্যয় কম হবে।
“তাই রিজার্ভ আর কমার কারণ নেই। তবে জানুয়ারিতে আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের পেমেন্ট আছে ১ বিলিয়নের (১০০ কোটি) মতো। তারপরও সব মিলিয়ে রিজার্ভ ভালো হবে বলা যায়।”
চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। অনুমোদনের দুই দিনের মাথায় ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড় করে সংস্থাটি; যোগ হয় রিজার্ভে।
গত ১২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফের সদর দপ্তরে সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে বাংলাদেশের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৯ কোটি ডলার অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৫ ডিসেম্বর ওই অর্থ বাংলাদেশের রিজার্ভে জমা হয়।
অন্যদিকে গত ৮ এডিবির বোর্ড সভায় ৪০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তার একটি ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। ১১ ডিসেম্বর রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সম্মেলন কক্ষে এডিবি ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে এই ঋণের চুক্তি সই হয়। ১৪ ডিসেম্বর রিজার্ভে জমা হয় সেই ঋণ।
এছাড়া জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশকে ৯ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (সাবপ্রোগ্রাম-১) নামের একটি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এই ঋণ গ্রহণ করা হলেও বাজেট সহায়তা হিসেবে এই অর্থ একসঙ্গে ছাড় হয়ে রিজার্ভে যুক্ত হয়েছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়া ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়। এর পর পরই সেই অর্থ রিজার্ভে যোগ হয়।
এদিকে রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। অক্টোবর, নভেম্বরের পর বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরেও রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ের ঊর্ধ্বমূখী ধারা দেখা যাচ্ছে।
অক্টোবরের পর নভেম্বর মাসেও প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অক্টোবরে পাঠিয়েছিলেন ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার; নভেম্বরে এসেছিল ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।
নভেম্বরের রেমিটেন্স ছিল গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালের নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ (১.৫৯ বিলিয়ন) প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল।
বিদায়ী ২০২৩ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২২ দিনে (১ থেকে ২২ ডিসেম্বর) ১০৭ কোটি ডলার রেমিটেন্স দেশে এসেছে। মাসের বাকি ৯ দিনে (২৩ থেকে ৩১ ডিসেম্বর) এই হারে রেমিটেন্স আসলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন (২২১ কোটি ২২ লাখ) ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে।
গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ওই দিন ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
১২ জুলাইয়ের আগে শুধুমাত্র ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। ওই বছরের ২৪ আগস্ট রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
এর পর থেকে কমছিল। এক বছর আগে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৩৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।
কমেন্ট