ভোটের আগে বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ১৮৪ কোটি ৫০ লাখ (১.৮৪ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছে দেশে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ কম।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম একটি উৎস হলো প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)। কিন্তু এই সূচকে কোনো সুখবর নেই; উল্টো জাতীয় নির্বাচনের আগে হতাশার খবর পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বিদেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ১৮৪ কোটি ৫০ লাখ (১.৮৪ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছে দেশে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ কম।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ২১৫ কোটি ৮০ লাখ (২.১৬ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ।
নিট এফডিআই কমেছে ১০ দশমিক শূন্য আট শতাংশ। এই পাঁচ মাসে ৬৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে দেশে। গত বছরের এই সময়ে এসেছিল ৭৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
দুই বছরের করোনা মহামারির পর প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো হোঁচট খেলেও বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৬৩ কোটি ৫৬ লাখ (৪.৬৩ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে। নিট এফডিআইয়ের অঙ্ক ছিল ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৬৩ কোটি ৫৬ লাখ (৪.৬৩ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে। নিট এফডিআইয়ের অঙ্ক ছিল ৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি বিনিয়োগ কমে। এর সঙ্গে নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলার সংকট, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি, মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতি,বিনিময় হারের দ্রুত পরিবর্তন ইত্যাদি কারণেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না।
এছাড়া ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে পিছিয়ে থাকা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, তথ্যের ঘাটতি, দক্ষ শ্রমিকের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশে বড় মূলধনি বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “দীর্ঘদিন দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করায় বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হয়েছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ১০-১২টির কাজ শেষের দিকে।”
“করোনা ও যুদ্ধের মধ্যেও মোটামুটি একটা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল দেশের অর্থনীতি। অল্প সময়ের মধ্যে আইএমএফের ঋণ পায় বাংলাদেশ। তাদের পরামর্শে বা কথামতো কিছু সংস্কার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। সবাই প্রত্যাশা করেছিল এসবের ইতিবাচক প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগে পড়বে।”
কিন্তু নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন আর বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। সে কারণে এফডিআই কমছে বলে মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদ।
“তবে একটি দেশে বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। দেশে বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। সন্তোষজনক রিজার্ভ থাকতে হয়। বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ ও সরকারের নীতি-সহায়তা প্রয়োজন হয়।”
দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরে দেশে বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩০ থেকে ৩১ শতাংশের মধ্যে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছেই। দেশি বিনিয়োগ যদি বাড়ে, ডলারের বাজারের অস্থিরতা যদি কেটে যায় তাহলে দেশে দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগই বাড়বে।”
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩.২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল দেশে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৩ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ওই বছর। এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা।
বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট এফডিআই বলা হয়।
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। মূলধন হিসেবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসেবে, বাংলাদেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে পুনর্বিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। এই তিন পদ্ধতির যেকোনোভাবে দেশে বিনিয়োগ এলে তা এফডিআই হিসেবে গণ্য করা হয়।
কমেন্ট