বিদেশি ঋণ: এক মাসেই এসেছে ২ বিলিয়ন ডলার

বিদেশি ঋণ: এক মাসেই এসেছে ২ বিলিয়ন ডলার

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৪ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ-সহায়তা দেশে এসেছে, তার মধ্যে ১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারই চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৪০৬ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার (৪.০৬ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে এসেছিল ২১১ কোটি ৭০ লাখ (২.১১ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরেই প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার (২০০ কোটি) এসেছে। আর এ কারণেই বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের পতন ঠেকানো গিয়েছিল। যদিও ৮ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আবার কমে এসেছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বুধবার বিদেশি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি যে ঋণ-সহায়তা দেশে এসেছে, তার মধ্যে ১৫৬ কোটি ৭৪ লাখ ৪০ হাজার (১.৫৬ বিলিয়ন) ডলার চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে।

হিসাব বলছে, মোট ঋণ-সহায়তার ৩৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এর মধ্যে আসল ৯২ কোটি ৬২ লাখ ডলার; আর সুদ বাবদ গেছে ৬৪ কোটি ১৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই ছয় মাসে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছিল ২৭ কোটি ৫১ লাখ ১২ হাজার ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সুদ পরিশোধে ১৩৩ দশমিক ২২ শতাংশ বা প্রায় আড়াই গুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়েছে সরকারকে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বুধবার বিদেশি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকুলে ৪ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ-সহায়তা ছাড় করেছে তার মধ্যে ৩৮৮ কোটি ১৬ লাখ (৩.৮৮ বিলিয়ন) ডলার প্রকল্প ঋণ। আর ১৮ কোটি ২০ লাখ ডলার অনুদান। অনুদানের মধ্যে ১৭ কোটি ১৭ লাখ ডলার প্রকল্প সহায়তা। আর ১ কোটি ৫ লাখ ডলার খাদ্য সহায়তা।

গত বছরের শুরু থেকে সরকারের বিদেশি ঋণ গ্রহণ বাড়তে শুরু করেছিল। তবে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এসে তা কিছুটা কমে যায়। সরকারের ঋণ গ্রহণ কমলেও বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়ে গেছে। ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়ায় চাপ তৈরি হয়েছে ডলারের বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের ( সরকারি ও বেসরকারি)  স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৫২৬ কোটি ডলার বা ৭৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জানুয়ারিতে সরকারের বিদেশি ঋণ স্থিতি ছিল ৭২ দশমিক ২১ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ২২১ কোটি ডলার, মার্চে তা বেড়ে হয় ৭৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ৩৫৫ কোটি ডলার। জুনে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলারে।

এদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার হিসাবেও ঋণ পরিশোধ অনেক বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ঋণ বাবদ ১৭ হাজার ২৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এরমধ্যে আসল শোধ করা হয়েছে ১০ হাজার ১৮৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আর সুদ বাবদ শোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ৫৬ কোটি ১২ লাখ টাকা।

গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সুদ-আসল বাবদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। যার মধ্যে আসল ছিল ৭ হাজার ৪৯৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা; সুদ ২ হাজার ৬৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, বেশ কিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় সার্বিকভাবে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে। যেমন মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। তবে ঋণ পরিশোধের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় আছে।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরে একই সময়ে বিদেশি ঋণ-সহায়তার অর্থছাড় সাড়ে ৭ শতাংশ বেড়েছে। গত জুলাই–ডিসেম্বরে উন্নয়ন সহযোগীরা সব মিলিয়ে ৪০৬ কোটি ডলার ছাড় করেছে। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৩৭৮ কোটি ডলার।

তবে এ সময়ে অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে অনেক বেশি। গত ছয় মাসে উন্নয়ন সহযোগীরা প্রায় ৭০০ কোটি (৭ বিলিয়ন) ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ ও অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আগের বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৭৬ কোটি (১.৭৬ বিলিয়ন) ডলার।

ডলারের সংকট ও ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়েছে। গত ১৭ জানুয়ারি ‘গ্রস’ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২০ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার।

আকুর বিল পরিশোধের আগে বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৭ বিলিয়ন ডলার।

এক বছর আগে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার।

গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তার আগে শুধু ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক।

সরকারের বিদেশি ঋণ সরাসরি পরিশোধ করা হয় রিজার্ভের অর্থ দিয়ে। পাশাপাশি ব্যাংকের আমদানি দায় মেটাতেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত।

সবচেয়ে বেশি দিয়েছে এডিবি

ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সবচেয়ে বেশি ঋণ-সহায়তা ছাড় করেছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই ছয় মাসে সংস্থাটি ১১১ কোটি ১৪ লাখ ২০ হাজার (১.১১ বিলিয়ন) ডলার দিয়েছে। এই অঙ্ক মোট ঋণ-সহায়তার ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এডিবির ঋণের অঙ্ক ছিল অর্ধেকেরও কম, ৪৪ কোটি ৪২ লাখ ৭০ হাজার ডলার।

অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে দিয়েছে ৮১ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার ডলার। জুলাই-নভেম্বরে ছিল ৬১ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার।

জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ৮৯ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার ডলার দিয়েছে। জুলাই-নভেম্বরে দিয়েছিল অর্ধেকেরও কম ৩৮ কোটি ৭৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার।

এছাড়া ভারত দিয়েছে ১৬ কোটি ২০ লাখ ২০ হাজার ডলার। চীন দিয়েছে ৩৬ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার, রাশিয়া ৫৪ কোটি ৪১ লাখ ডলার এবং এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) ছাড় করেছে ২ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।

ডিসেম্বরে বিদেশি ঋণ বাড়ার পেছনে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৯ কোটি ডলারেরও অবদান ছিল।

সংকট কাটাতে আরও ঋণ প্রয়োজন

দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। এই চাপ সামাল দিতে আরও বেশি বিদেশি ঋণ-সহায়তার প্রয়োজন বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “স্বস্তির খবর এই যে, গত ডিসেম্বরে আইএমএফ, এডিবি ও কোরিয়ার ঋণ পাওয়ায় বিদেশি ঋণ সহায়তা বেড়েছে। অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসাবে ফরেন এইড ছিল ২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। ছয় মাস শেষে তা ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে এই তিন সংস্থার ঋণে। এতে রিজার্ভের পতন ঠেকানো গিয়েছিল। তা নাহলে রিজার্ভ আরও কমে যেত।

“এখন কিন্তু রিজার্ভ আবার আগের অবস্থায় নেমে এসেছে। রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে আরও ঋণ-সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে নতুন সরকারকে।”

“যেসব ঋণ পাইপলাইনে আটকে আছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় করাতে দাতাদের সঙ্গে দেন-দরবার করতে হবে।”

সংকট কাটাতে কম সুদের আরও বিদেশি ঋণ এখন খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।

দুই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চাপে পড়া অর্থনীতিকে সামাল দিতে কম সুদের বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বেশ অবদান রেখেছিল।

কিন্তু সেই জোয়ার আর থাকেনি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। সেই নেতিবাচক ধারা নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছর শুরু হয়।

২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।

তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলার।

বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থ ছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।

রোজায় ৮ পণ্য বাকিতে আমদানির সু‌যোগ পরবর্তী

রোজায় ৮ পণ্য বাকিতে আমদানির সু‌যোগ

কমেন্ট