রপ্তানি আয় রেমিটেন্সের উল্লম্ফনেও বাড়ছে না রিজার্ভ
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়। কিন্তু এই দুই সূচকের উল্লম্ফনেও দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক রিজার্ভ বাড়ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার রিজার্ভের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। আর ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ডলার।
আগের সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবারও (১ ফেব্রুয়ারি) এই দুই হিসাবেই রিজার্ভ ছিল প্রায় একই। বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক শূন্য আট বিলিয়ন ডলার।
তার আগের সপ্তাহের বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারি) বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না কেনো? অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলেছেন, রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির কারণেই বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বাড়ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ১ ফেব্রুয়ারি রেমিটেন্সের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে প্রবাসীরা ২১০ কোটি (২.১০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। অঅগের মাস ডিসেম্বরের চেয়ে বেশি ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
অন্যদিকে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও জানুয়ারি মাসে রপ্তানি আয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। এই মাসে পণ্য রপ্তানি করে ৫৭২ কোটি ৪৩ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা। যা গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।
একক মাসের হিসাবে এই আয় অতীতের যে কোনো মাসের চেয়ে বেশি। এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫৩৬ কোটি ৫২ লাখ (৬.৩৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল একক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রেমিটেন্স বেড়েছে ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।
ডলার বিক্রির কারণেই কমছে রিজার্ভ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি) রিজার্ভ থেকে সব মিলিয়ে ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত—আড়াই বছরে বিক্রি করা হয়েছে ২৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
আর এ কারণেই রিজার্ভের অন্যতম প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সে উল্লম্ফন দেখা দিলেও রিজার্ভ না বেড়ে উল্টো নিচের দিকে নামছে।
আমদানি কমায় এবং রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের আগস্টে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। কিন্তু এর পর থেকে কমতে কমতে এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ নভেম্বর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
এর আগে গত বছরের ৭ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। কমতে কমতে ১৩ ডিসেম্বর রিজার্ভ ১৯ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
এর পর আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৯ কোটি ডলার, ম্যালিাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৪০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৯ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
গত ৮ জানুয়ারি আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছিল ২৫ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে।
এর পর তা আরও কমে বৃহস্পতিবার বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছে ২৫ বিলিয়ন ডলারে।
গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ওই দিন ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
১২ জুলাইয়ের আগে শুধুমাত্র ‘গ্রস’হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক। এক বছর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। মহাসংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কা অবশ্য আকুর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
প্রতি দুই মাসের আমদানি বিল পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধ করে এসব দেশ।
জরুরি আমদানিতে সহায়তা দিতে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রির কারণেই মূলত রিজার্ভ কমেছে। যদিও আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখার নানা পদক্ষেপ চলমান রেখেছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, আগের চেয়ে বেশি দর পাওয়ার কারণে রেমিটেন্স বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ব্যাংকগুলো ডলারের যে দর ঘোষণা করছে, তার চেয়ে বাস্তবে বেশি। ডলারের সংকট থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তেমন কড়াকড়ি করছে না।
রিজার্ভ থেকে এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংকে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা। আগে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের চেয়ে ২/৩ টাকা কম দামে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের জুলাই থেকে আর কম দামে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না।
তবে সব ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে না। জ্বালানি তেল, সারসহ সরকারের প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অন্য ব্যাংকগুলোকে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) বিক্রি করা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
করোনা মহামারির কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়।
পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর।
এর পর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন।
তবে, এবিবি ও বাফেদার সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই মানেনি ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক এই দুই সংগঠনের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করেছে। এজন্য কয়েক দফায় কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করার পাশাপাশি জরিমানাও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সব দেশেই পড়েছে। সব দেশেই ডলারের দর বেড়েছে; মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। সামাল দিয়ে তারা কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব দেশেই মূল্যস্ফীতি কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে উঠে গিয়েছিল; এখন ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে তারা।
“কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি কমছে না। ডলার সংকট কাটছে না; ডলারের বাজারে অস্থিরতা যাচ্ছে না। রিজার্ভ কমছেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে সব দেশ পারলে আমরা পারছি না কেনো? আমাদের গলদ কোথায়? আমরা কী ঠিকঠাক মত ব্যবস্থাপনা করছি না।?”
“এখানে দুটি বিষয় আমি পরিস্কারভাবে উল্লেখ করতে চাই। দীর্ঘদিন ডলারের দর ধরে রেখে আমরা ঠিক কাজটি করিনি। ওইটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত।
“আরেকটি ভুল ছিল আমাদের- মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল; তারপরও আমরা ৯ শতাংশ সুদ হার দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলাম। এখন অবশ্য সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই দুই ভুলের মাশুলই আমাদের এখন দিতে হচ্ছে। আরও কতদিন দিতে হবে কে জানে?”
“কতদিন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হবে, তাও কিছু বলা যাচ্ছে না,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্ব পূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
কমেন্ট