‘সোয়াপ’ এর সুফল, রিজার্ভ ২০.৫ বিলিয়নে উঠেছে
সোয়াপ ব্যবস্থা চালুর আগের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১০ দিনের ব্যবধানে রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৬০ কোটি ডলার।
টাকা–ডলার অদলবদল (সোয়াপ) সুবিধায় ১২টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে ৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার জমা দিয়ে সমপরিমাণ টাকা নিয়েছে। সোয়াপ সুবিধা চালুর পর ১০ দিনে এই ডলার জমা হয়েছে।
আর এর ফলে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেশ খানিকটা বেড়েছে। গত রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
সোয়াপ ব্যবস্থা চালুর আগের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। বৃহস্পতিবার তা বেড়ে ২০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। রবিবার তা আরও বেড়ে ২০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১০ দিনের ব্যবধানে রিজার্ভ প্রায় ৬০ কোটি ডলার বেড়েছে। সোয়াপ ব্যবস্থা রিজার্ভ বাড়তে অবদান রাখছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক সময়ে ‘সঠিক’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বেশকিছু ব্যাংক ডলার জমা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছে। এসব ডলার জমার কারণে রিজার্ভ বেড়েছে। সামনে সেই ডলার ফেরত নিলে রিজার্ভ হয়তো কমতে পারে; তবে এর মধ্যে বিভিন্নভাবে রিজার্ভ বাড়বে।”
এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ১১০ টাকা দরে ব্যাংকগুলো প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কিনছে। এই দামেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার অদলবদল করেছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার নিয়ে সমপরিমাণ টাকা দিচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এক সার্কুলার জারি করে টাকার সঙ্গে ডলার অদলবদল বা সোয়াপব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার নিয়ে সমপরিমাণ টাকা দিচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে।
নতুন এ ব্যবস্থার ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ডলার–টাকা অদলবদল করতে পারছে। সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ দিনের জন্য টাকা-ডলার অদলবদলের এ ব্যবস্থা চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সুবিধা চালুর পর প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার জমা দিয়ে সমপরিমাণ টাকা নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত রবিবার পর্যন্ত (২৫ ফেব্রুয়ারি) ১২টি বেসরকারি ব্যাংক ৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিয়ে তার বিপরীতে সমপরিমাণ টাকা নিয়েছে। এর বাইরে এই ১গ দিনে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৫ কোটি ডলারের মতো কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সময়ে আমদানি দায় মেটাতে সমপরিমাণ ডলার বিক্রিও করেছে।
দুই বছর ধরে দেশে ডলার–সংকট চলছে। এর ফলে রিজার্ভ কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। ডলার–সংকট সামাল দিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তাতে চাহিদা কিছুটা কমলেও ডলারের সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি।
ফলে আমদানি দায় মেটাতে এখনো প্রতি ডলারের জন্য ১২৩ টাকা পর্যন্ত দাম দিতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। আবার কিছু ব্যাংক ঘোষণার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে প্রবাসী আয়ের ডলার কিনছে।
ডলারের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকে টাকারও সংকট চলছে। কারণ, ব্যাংকগুলোকে নগদ টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে। আবার অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেও তারল্যসংকটে পড়েছে কিছু ব্যাংক। তবে কোনো কোনো ব্যাংকের কাছে বাড়তি কিছু ডলারও রয়েছে। সেসব ডলার এখন তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়ে তার বিপরীতে সমপরিমাণ টাকা নিচ্ছে।
ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টাকা–ডলার অদলবদলের এ ব্যবস্থা উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক। কারণ, উদ্বৃত্ত ডলারের বিপরীতে ব্যাংকগুলো তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পেয়ে যাবে। আবার নির্ধারিত সময় পর টাকা ফেরত দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সমপরিমাণ ডলার পেয়ে যাবে। এ ব্যবস্থার আওতায় সর্বনিম্ন ৫০ লাখ ডলার বা তার সমপরিমাণ টাকা অদলবদল করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলোর সাধারণ ব্যাংকিং থেকে অফশোর ইউনিটে ডলার স্থানান্তর বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি মূল ব্যাংক থেকে অফশোর ইউনিটে যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তা-ও চলতি বছরের মধ্যে ফেরত আনতে বলা হয়েছে।
অফশোর ব্যাংকিংয়ে ডলার স্থানান্তর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ব্যবসার জন্য বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে ডলার ধার এনেছে, তা ব্যবহার করতে পারছে না। এখন এসব ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিয়ে টাকা নিয়ে সেই অর্থ ঋণ হিসেবে দিতে পারছে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার জমা হওয়ায় বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রিজার্ভসহ অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে।
তাতে দেখা যায়, এক মাস আগে ২৪ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
চলতি মাসের প্রথম দিন ১ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে নামে ২৫ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ডলার।
৭ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক শূন্য আট বিলিয়ন ডলার।
১৫ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল একই, ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার।
২০ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। সবশেষ ২৫ ফেব্রুয়ারি তা আরও বেড়ে ২০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
আমদানি কমায় এবং রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের আগস্টে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। কিন্তু এর পর থেকে কমতে কমতে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ ডিসেম্বর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ ২০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ওই দিন ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
১২ জুলাইয়ের আগে শুধুমাত্র ‘গ্রস’হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক। এক বছর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।
জানতে চাইলে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “জানুয়ারি মাসে প্রবাসী আয় আসা আগের মাসগুলোর তুলনায় বেড়েছে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স আসবে বলে মনে হচ্ছে। আবার রপ্তানি আয়ও বেশ ভালো আসছে।”
“এ ছাড়া আর্থিক হিসাবের বেশ উন্নতি হয়েছে। সেই সঙ্গে চালু করা হয়েছে টাকা–ডলার অদলবদল বা সোয়াপ–পদ্ধতি। এ চারটি কারণেই মূলত রিজার্ভের উন্নতি হয়েছে। আমরা আশা করছি প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের এ ধারা আগামীতে অব্যাহত থাকলে রিজার্ভের আরও উন্নতি হবে।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সোয়াপ ব্যবস্থা একটা ভালো উদ্যোগ। দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সব দেশেই পড়েছে। সব দেশেই ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। রিজার্ভ কমেছে। বাংলাদেশেও একই রকম প্রভাব পড়েছে। এরই মধ্যে অনেক ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। কলমানি রেট বেড়ে যাচ্ছে।”
“নতুন এই ব্যবস্থার ফলে ব্যাংকগুলো এখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত ডলার রেখে বাকিটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিয়ে টাকা নিতে পারবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের জমা বাড়লে রিজার্ভও বাড়বে। তাই ডলার-টাকা অদলবদলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও লাভবান হচ্ছে।”
কমেন্ট