বিদেশি ঋণে রেকর্ড, ছাড়াল ১০০ বিলিয়ন ডলার
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯৬ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে,তিন মাসে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে বিদেশি ঋণের অঙ্ক ৪ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এই তিন মাসে সরকার ৪৪২ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ নিয়েছে। তার বিপরীতে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি কমেছে ৬৪ কোটি ডলারের।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের অঙ্ক ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২৩ সাল শেষে সামগ্রিক বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার; এক বছর আগে যা ছিল ৯৬ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
এই ঋণের মধ্যে ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার নিয়েছে সরকারি খাত। বাকি ২০ কোটি ৯১ বিলিয়ন ডলার অংশ নিয়েছে বেসরকারি খাত। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ ঋণ দীর্ঘমেয়াদি, বাকিগুলো স্বল্পমেয়াদি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯৬ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে,তিন মাসে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে বিদেশি ঋণের অঙ্ক ৪ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এই তিন মাসে সরকার ৪৪২ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ নিয়েছে। তার বিপরীতে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি কমেছে ৬৪ কোটি ডলারের।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার ও বেসরকারি খাত মিলে ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারের যে বিদেশি ঋণ নিয়েছে, টাকার অঙ্কে তার পরিমাণ (প্রতি ডলার=১১০ টাকা ধরে) ১১ ট্রিলিয়ন বা ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯৬ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। আর গত ২০২২–২৩ অর্থবছর শেষে তা ৯ হাজার ৮১১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অর্থাৎ গত আট বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত ডিসেম্বর শেষে সেটি আরও বেড়েছে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা শুমারির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। সেই হিসাবে গত ডিসেম্বরের শেষে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৯২ ডলার (প্রায় ৬৫ হাজার টাকা)। যদিও গত জুনের হিসাবে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ছিল ৫৭৪ ডলার। আট বছর আগে এটা ছিল ২৫৭ ডলারের কিছু বেশি।
বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্কলন হলো, আগামী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) এ বাবদ ব্যয় দাঁড়াবে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আসল ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি এবং সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এর মানে দুই বছরের মাথায় বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হবে। ক্রমবর্ধমান পরিশোধের চাপ মাথায় রেখে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হচ্ছে সরকারকে।
সরকারের পক্ষে বিদেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধের দায়িত্বে রয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি। পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকায় সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্ধারিত ব্যয়সীমা ১৬ হাজার কোটি টাকা বাড়াতে চিঠি দিয়েছে ইআরডি।
ইআরডি সচিব শাহ্রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিদেশি ঋণের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অধিক হারে বৈদেশিক ঋণ আহরণ করা হয়েছে। ফলে পরিশোধিত ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাছাড়া নতুন ঋণের পরিশোধও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
কিন্তু ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের বর্তমান ধারা ও আগামীর চাহিদা পর্যালোচনা করে ইআরডি বলছে, এ ব্যয়সীমার মধ্যে বাজেট প্রণয়ন সম্ভব নয়। কারণ বিদেশি ঋণ-সংক্রান্ত দায় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগামী বছরগুলোতে তা আরও বাড়বে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হয় ৪ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। এর পরের অর্থবছর তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর পরের দুই অর্থবছর (২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭) এ ক্ষেত্রে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ হচ্ছে যথাক্রমে ২১ হাজার ৩৭৫ কোটি এবং ২৪ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।
এদিকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাবদ গত ২০২১-২২ অর্থবছর ব্যয় হয় ১৩ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। এর পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর কিস্তি পরিশোধ বাবদ ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর পরের দুই অর্থবছর এ ক্ষেত্রে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ হচ্ছে যথাক্রমে ৪১ হাজার ৩৫৯ কোটি এবং ৪৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ এখনও সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ হার প্রায় ২২ শতাংশ। তবে রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি সার্বিকভাবে রাজস্ব বাড়াতে না পারলে বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধ অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ ডেট সাসটেইনেবল অ্যানালাইসিস অনুযায়ী বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কম ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “জিডিপি নয় বরং রাজস্ব আয়ের অনুপাতে ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কারণ ঋণ পরিশোধে টাকা কিংবা ডলার প্রয়োজন। জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের হার অত্যন্ত কম। রাজস্ব আয়ের অনুপাতে বাংলাদেশের ঋণ ৩৮০ শতাংশের মতো। সার্বিকভাবে ঋণের দায় পরিশোধ দেশের অর্থনীতিতে সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অর্থনৈতিক ধীরগতি শিগগির কাটছে না– এমনটি ধরে নিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করে বাজেট সংশোধন হচ্ছে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দিয়ে মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও সংকোচনমূলক বাজেট প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
“এর আলোকে নির্ধারিত ব্যয়সীমার মধ্যে থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে বাজেট প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ইআরডি ব্যয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। বিষয়টি পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
কমেন্ট