রিজার্ভ কমে আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তিতে সংশয় বাড়াচ্ছে
গত জানুয়ারি মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আরও কমেছে। বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৪ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া নানা পদক্ষেপের পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। আর এতে আইএমএফ চলতি মাস মাস শেষে ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া দিয়েছিল, তা পূরণ হবে না। তাতে সংস্থাটির তৃতীয় কিস্তির ঋণ পাওয়া নিয়ে সংশ্রয় দেখা দেবে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
গত ৭ মার্চ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের ১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আর ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নামে ২৫ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলারে।
আকুর দেনা শোধের আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারে।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৫৩ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে কমেছে ২২ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ গত জানুয়ারি মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়ার পথ মসৃণ করতে রিজার্ভ বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংস্থাটি নতুন যে শর্ত দিয়েছে, তাতে চলতি মার্চ মাস শেষে বাংলাদেশের প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।
এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য সোয়াপ কারেন্সি সুবিধার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা বাড়তি ডলার রিজার্ভে জমা করাসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও রিজার্ভ কমছে।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এক সার্কুলার জারি করে টাকার সঙ্গে ডলার অদলবদল বা সোয়াপব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার নিয়ে সমপরিমাণ টাকা দিচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে।
টাকা–ডলার অদলবদল (সোয়াপ) সুবিধার আওতায় বুধবার পর্যন্ত ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার রেখে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি তারল্য সহায়তা নিয়েছে সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংক।
অন্যদিকে বাজারে ডলার সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত) প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। আর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) বিক্রি করেছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন হয় ১২ ডিসেম্বর। তবে নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় বাংলাদেশ এ শর্তে কিছুটা ছাড় চাইলে সংস্থাটি তা পুনর্নির্ধারণ করে।
আইএমএফের নতুন শর্ত অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন, এ বছরের মার্চ শেষে ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ও জুন শেষে ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে। ডিসেম্বরের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি গেলেও তা পূরণ সম্ভব হয়নি।
মার্চ মাস শেষ হতে তিন দিন বাকি; এই মাসের লক্ষ্যও পূরণ হবে না—এটা এখন নিশ্চিত।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, রিজার্ভ রাখার জন্য সোয়াপ কারেন্সি সুবিধাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। তারপরও মার্চ শেষে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না।”
তিনি বলেন, “বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ৩ থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার কম থাকে। বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ এখন ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। এখান থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে হিসাব করলেও নিট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের মতো। অর্থাৎ আইএমএফের শর্ত পূরণ হবে না।”
“এখন আইএমএফের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, কেনো রিজার্ভ নেই—সে বিষয়য়ে প্রশ্ন তুলবে সংস্থাটি। ডিসেম্বরের লক্ষ্য পূরণ হয়নি; মার্চেও পূরণ হলো না। সেক্ষেত্রে সংস্থটির তৃতীয় কিস্তি পাওয়া নিয়ে সংশ্রয় দেখা দিতে পারে,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ হলো আইএমএফের এসডিআর খাত, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে রাখা ডলার ও আকুর বিলের জন্য জমা থাকা ডলার বাদ দিয়ে যে হিসাব হয়, সেই রিজার্ভ। এর বাইরে রিজার্ভের আরও দুটি হিসাব রয়েছে। তার একটি হলো মোট বা ‘গ্রস’ রিজার্ভ। আরেকটি আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রক্ষিত রিজার্ভ।
তবে আইএমএফের চাওয়া শুধু নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ কত হবে, সেটা।
আমদানি কমায় এবং রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের আগস্টে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। কিন্তু এর পর থেকে কমতে কমতে এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।
গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ওই দিন ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
১২ জুলাইয়ের আগে শুধুমাত্র ‘গ্রস’হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক। এক বছর আগে ২৭ মার্চ ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার।
কমেন্ট