রিজার্ভ বাড়ছে, দুই সপ্তাহে বেড়েছে ৫০ কোটি ডলার

রিজার্ভ বাড়ছে, দুই সপ্তাহে বেড়েছে ৫০ কোটি ডলার

কোরবানির ঈদ এবং টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পালে হাওয়া লাগায় পতনের ধারা থেকে রিজার্ভ ঊর্ধ্বমূখী হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আরও খানিকটা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।

গত ২১ মে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ১১ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ১৩ কোটি ডলার। দুই সপ্তাহে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৪৭ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ৫০ কোটি ডলার।

কোরবানির ঈদ এবং টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পালে হাওয়া লাগায় পতনের ধারা থেকে রিজার্ভ ঊর্ধ্বমূখী হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। জুন মাসের শেষের দিকে আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়ায যাবে। তখন রিজার্ভ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উৎকণ্ঠার এক নাম এখন রিজার্ভ। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছিল ২৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সপ্তাহে একদিন রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে। সেই তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ মে আইএমএফ হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।

১৪ মে আকুর দেনা শোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছিল ২৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে।

হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, দুই সপ্তাহে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৪৭ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ৫০ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এআরএইচ ডট নিউজকেকে বলেন, “কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। ডলারের দাম বাড়াতেও রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়েও প্রভাব পড়েছে। সব কিছু মিলিয়ে রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে।”

“জুন মাসে আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে  রিজার্ভ এখন আর কমবে না; বাড়তেই থাকবে।”

এর আগে গত ১১ মার্চ আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের ১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছিল ২৫ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলারে।

৯ জানুয়ারি আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছিল ২০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছিল ২৫ দশমিক ৭৫ ডলারে।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এর পর থেকে তা কমতে থাকে।

এক বছর আগে গত বছরের ২৯ মে ‘গ্রস’ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে কমতে কমতে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামে।

১৩ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এর পর আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৯ কোটি ডলার, এডিবির ৪০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৯ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। ‘গ্রস’ হিসাবে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই দিন ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

১২ জুলাইয়ের আগে শুধু ‘গ্রস’হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।

সবশেষ গত মার্চ মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।

সে হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ বর্তমানের ১৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে পৌনে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। সেই ক্ষেত্রে রিজার্ভ এখনও টানটান অবস্থায় আছে।

আকু হলো—কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্ত–আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়।

অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে শ্রীলঙ্কা।

২৪ দিনে এসেছে ১.৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স

বাংলাদেশ ব্যাংক সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি মে মাসের ২৪ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের মে মাসের পুরো সময়ের চেয়েও ৫ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।

২০২৩ সালের মে মাসে ১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।

বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে মে মাসের ২৪ দিনে ২০ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলার বা ৮৭২ কোটি টাকা ২৫ লাখ টাকা।

মাসের বাকি ৭ দিনে (২৫ থেকে ৩১ মে) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। যা হবে একক মাসের হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।

এর আগে ২০২১ সালের জুলাইয়ে এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।

নিট রিজার্ভ

বিপিএম-৬ ও ‘গ্রস’ হিসাবের বাইরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না।

বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভ থেকে আকুর দায়, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা অর্থ এবং আইএমএফের স্পেশাল ড্রয়িং রাইট (এসডিআর) হিসেবে থাকা ডলার বাদ পড়বে। আর এ সব বাবদ বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভ থেকে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে।

এ হিসাবে বাংলাদেশের প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ ১৪ বিলিয়ন ডলারেরে উপরে অবস্থান করছে।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকেকে, “হতাশ হওয়ার কিছু নেই। গত ৯ মে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ডলার বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করেছে। এর পর থেকে ডলারের বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে েইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। রিজার্ভও বাড়বে।”

তিনি বলেন, “রিজার্ভ কমায় সার্বিক বিষয় বিবেচনা নিয়ে আইএমএফ বাংলাদেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়েছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত আইএমএফের দেওয়া নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। এ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আইএমএফ ১৪ দশমিক ৭৫ কোটি ডলারে নামিয়েছে। এটা একটা স্বস্তির খবর।”

“আমার মনে হয়, রিজার্ভ আর কমবে না; বাড়তেই থাকবে,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।

কয়েক মাসের মধ্যে রিজার্ভ স্থিতিশীল হবে: মুডি’স পরবর্তী

কয়েক মাসের মধ্যে রিজার্ভ স্থিতিশীল হবে: মুডি’স

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর