রিজার্ভের পতন থামেনি, কমেছেই
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বুধবার বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। আর ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমছেই; পতন থামছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা গত মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় দাবি করেছিলেন, রিজার্ভের পতন থামানো গেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় রিজার্ভ বেড়েছে; আর তাতেই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের পতন থেমেছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে হুসনে আরা শিখার দাবির সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মঙ্গলবার বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বুধবার বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
ভিডিও বার্তায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, “সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।”
দেশে প্রবাসী আয় ক্রমশ বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত জুলাই থেকে আগস্টে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে। প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। রিজার্ভ বৃদ্ধির বড় কারণ প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি।
রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে জানিয়ে মুখপাত্র শিখা বলেন, “ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ক্ষয়রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। কারণ রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধি ঘটছে। গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
“আমরা যদি জুলাইয়ের সঙ্গে অগাস্টের প্রবৃদ্ধি ধরি, তাহলে এটা প্রায় ৯০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আন্তঃব্যাংক ফরেন এক্সচেঞ্জ সক্রিয় করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো চাইলে নিজেরা কেনাবেচা করতে পারছে এবং বিনিময়হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে।”
শিখা বলেন, “আন্তঃব্যাংক লেনদেন সক্রিয় থাকার কারণে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেটের যে মার্কেট বা ডলারের দাম স্টাবিলাইজ (স্থিতিশীল) থাকবে বলে আমরা মনে করি।”
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে রিজার্ভের পাশপাশি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকের হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়।
সেই ধারাবাহিকতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সপ্তাহের শেষ দিন ১২ সেপ্টম্বর যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তাতে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।
গত ৯ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মাসের ১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে যায়। আকুর দেনা শোধের আগে ৫ সেপ্টেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই তথ্য বলছে, গত দুই সপ্তাহে রিজার্ভ বাড়েনি; উল্টো কমছেই।
গত ২৯ আগস্ট বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
এক বছর আগে গত বছরের ১৮ সেপ্টম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৭ দমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি ব্যয় কমায় ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই দিন ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
১২ জুলাইয়ের আগে শুধু ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক।
রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থাকে জানিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ গত জুন মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে ১৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
সেই ক্ষেত্রে রিজার্ভ এখন একেবারেই টানটান অবস্থায় আছে।
আকু হলো—কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্ত–আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়।
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছর এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে শ্রীলঙ্কা।
কমেন্ট