রিজার্ভ নামল ১৮ বিলিয়নে, ৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন
রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ার পরও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উদ্বেগের এক নাম এখন বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধের পর সেই উদ্বেগ আরও বাড়ল। রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ার পরও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে পতন থামছে না।
আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল হয়েছিল। তা মিটিয়ে দেওয়ার পর মঙ্গলবার বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ এখন ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
এই রিজার্ভ ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। গত ১২ মে আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছিল ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছিল ২৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে।
এর কিছু দিন পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়: ‘গ্রস’ হিসাবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের উপরে ওঠে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এবার আকুর বেল একটু বেশি হয়েছে; ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। মঙ্গলবার সেই বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। ‘গ্রস’ হিসাবে দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।”
‘তবে উদ্বেগের কিছু নেই’ জানিয়ে তিনি বলেন, “১৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ছে। কিছুদিনের মধ্যেই রিজার্ভ আবার বাড়বে।”
রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮৯৪ কোটি (৮.৯৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলেছে এই চার মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ার পরও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ বিলিয়ন ডলারের সামান্য কিছু বেশি। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ৩১ অক্টোবর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার।
এক বছর আগে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার।
গত ৯ সেপ্টেম্বর আকুর জুলাই-আগস্ট মাসের ১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আকুর দেনা শোধের আগে ৫ সেপ্টেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি ব্যয় কমায় ২০২১ সালের আগস্টে বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই দিন ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
১২ জুলাইয়ের আগে শুধু ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক।
রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থাকে জানিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে ১৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আকু হলো—কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্ত–আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়।
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছর এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে শ্রীলঙ্কা।
কমেন্ট