আইএমএফের চতুর্থ কিস্তি মিলবে ডিসেম্বরের শেষে
তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে প্রায় ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের বাকি ২৩৯ কোটি (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার পাওয়া যাবে চার কিস্তিতে, যার এক (চতুর্থ) কিস্তি পাওয়া যেতে পারে আগামী মাসের শেষের দিকে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের চতুর্থ কিস্তি ডিসেম্বরের শেষের দিকে পাওয়া যাবে। আর তাতে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড়ের আগে তৃতীয় কিস্তির পর্যালোচনা করতে আইএমএফের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আগামী ৪ ডিসেম্বরে ঢাকায় আসছে। দলটি বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে দুই সপ্তাহ ধরে বৈঠক করবে। এ দফায়ও দলটির নেতৃত্ব দেবেন আইএমএফের গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রোইকোনমিকস বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও।
আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। এরপর তিন কিস্তির অর্থও পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। গত ডিসেম্বরে পেয়েছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। আর গত জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে।
তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে প্রায় ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের বাকি ২৩৯ কোটি (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার পাওয়া যাবে চার কিস্তিতে, যার এক (চতুর্থ) কিস্তি পাওয়া যেতে পারে আগামী মাসের শেষের দিকে।
তবে এই কিস্তিতে কতো ডলার পাওয়া যাবে—তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। যে প্রতিনিধি দলটি আসবে, তারা অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবে চতুর্থ কিস্তির অর্থের অঙ্ক।
জানতে চাইলে অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করতে আইএমএফের দলটি আগামী ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় আসছে। একাধিক বৈঠক হবে। সে সব বৈঠকে তৃতীয় কিস্তির ছাড় করা অর্থ নিয়ে পর্যালোচনা হবে। একইসঙ্গে চতুর্থ কিস্তির ঋণ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা ঋণটি পেয়ে যাবো।”
আইএমএফ থেকে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) এবং বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ মোট ঋণ পাওয়ার কথা ৩৩০ কোটি (৩ বিলিয়ন) ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ ১৪০ কোটি (১.৪ বিলিয়ন) ডলার।
আইএমএফের নতুন তহবিল হচ্ছে আরএসএফ, যা থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ঋণ পায়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর আইএমএফের বড় কোনো দলের ঢাকা সফর এবারই প্রথম। যদিও গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আইএমএফের বার্ষিক সাধারণ সভায় যোগ দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সংস্থাটির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইএমএফের দলটি ঢাকায় অবস্থান করবে। ফিরে যাওয়ার আগে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলবেন দলটির প্রধান। একইসঙ্গে চতুর্থ কিস্তির ঋণের বিষয়েও জানাবেন।
দলটির মনোভাব ইতিবাচক হলে ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে আইএমএফ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেবেন। সেই প্রতিবেদনের আলোকে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদ চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় করবে। সেটা ডিসেম্বরের মধ্যেই হবে জানান কর্মকর্তারা।
চলমান ঋণ কর্মসূচির বাইরে সংস্থাটি থেকে বাড়তি ৩০০ কোটি (৩ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পাওয়ার একটি চেষ্টা আছে বাংলাদেশের। আইএমএফের দলের এবারের ঢাকা সফর শেষে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উদ্বেগের এক নাম এখন রিজার্ভ। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধের পর সেই উদ্বেগ আরও বেড়েছে। রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ার পরও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক বাড়ছে না।
গত ১২ নভেম্বর আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নামে ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে ১৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার বাড়লেও মূল্যস্ফীতি এখনো ১১ শতাংশের কাছাকাছি। রাজস্ব সংগ্রহের গতিও কম। ভর্তুকির চাপও আছে। খেলাপি ঋণও বেড়ে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
তবে আর্থিক খাত সংস্কারে বহুমুখী কার্যক্রমে হাত দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, যা আইএমএফের দলের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠকগুলোতে তুলে ধরবে বাংলাদেশ।
সাড়ে তিন বছরের মেয়াদের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কার্যক্রমের বিপরীতে আইএমএফ অনেক শর্ত দেয় বাংলাদেশকে। সব শর্ত পূরণ করতে না পারলেও তিন কিস্তির অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ। চতুর্থ কিস্তি মিলবে গত জুন পর্যন্ত আইএমএফের দেওয়া শর্ত পূরণের মূল্যায়নের ভিত্তিতে। তিনবারই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ।
আইএমএফের মতে, নিট রিজার্ভ হচ্ছে প্রকৃত রিজার্ভ। আইএমএফের শর্ত মেনে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে এ নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর বাধ্যবাধকতা আছে। ব্যর্থ হওয়ায় আইএমএফের কাছে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমাতে আনুষ্ঠানিকভাবে অব্যাহতি চায় বাংলাদেশ, সংস্থাটি তা অনুমোদনও করে।
গত ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ পরে তা কমিয়ে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার রাখার শর্ত দেয়। তবে ডিসেম্বর–ভিত্তিক নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। মার্চেও নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। মার্চ শেষে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ১৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার, সেখানে তা ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ ১৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ও ডিসেম্বর শেষে তা ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে।
গত ৩ জুলাই প্রথমবারের মতো নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভের (এনআইআর) হিসাব প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন দেশের নিট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।
এর পরে অবশ্য নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক সপ্তাহ পর পর ‘গ্রস’ ও বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভ প্রকাশ করলেও নিট হিসাব প্রকাশ করা হয় না।
নিট রিজার্ভ হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি থেকে সব ধরনের দায়দেনা বাদ দেওয়ার পর যা থাকে সেটা। সে হিসাবে বাংলাদেশের পেক্ষাপটে ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো কম থাকে। আর বিপিএম-৬ হিসাবের চেয়ে কম থাকে ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।
সে হিসাবে বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, চতুর্থ কিস্তির অর্থ পেতে কোনো সমস্যা হবে না বাংলাদেশের। তিনি বলেন, “দুইবার রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এমন জায়গায় নামিয়ে আনা হয়েছে যে এখন আর তা অর্জন করতে কষ্ট হবে না। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ (রেমিট্যান্স) ভালো। ফলে কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্ত কোনো বাধা হিসেবে আসবে না।”
কমেন্ট