বিদেশি ঋণ: আসছে কম, পরিশোধ বেশি

বিদেশি ঋণ: আসছে কম, পরিশোধ বেশি

বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার মোটা অঙ্কের ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। নতুন সরকারের সাড়ে চার মাস পার হয়েছে। কিন্তু সেই ঋণ এখনো দেশে আসেনি।

চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) যত বিদেশি ঋণ এসেছে, তার চেয়ে বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। এই পাঁচ মাসে সুদ ও আসল মিলিয়ে ১১১ কোটি ১০ লাখ ৩০ হাজার (১.৭১ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা দিয়েছে ১৫৪ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার (১.৫২ বিলিয়ন) ডলার। তাতে অর্থ পাওয়ার চেয়ে ঋণ পরিশোধে ১৬ কোটি ৭৩ লাখ ডলার বেশি খরচ হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার মোটা অঙ্কের ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। নতুন সরকারের সাড়ে চার মাস পার হয়েছে। কিন্তু সেই ঋণ এখনো দেশে আসেনি।

তবে বিশ্বব্যাংকের ৫০ কোটি ডলার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৬০ কোটি ডলার—মোট ১ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চলতি ডিসেম্বর মাসেই এই ঋণ দুটি পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

গত ২২ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে বেগবান করতে বিশ্বব্যাংক ৫০ কোটি ডলার ও এডিবি ৬০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা অনুমোদন করেছে।

তাতে বলা হয়, “মোট ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই বাজেট সহায়তা চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।”

বাজেট সহায়তার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে ৩৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং চট্টগ্রামে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে ২৮ কোটি ডলার প্রকল্প সহায়তাও অনুমোদন করেছে।

এরই মধ্যে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) শেষ হতে চলেছে। এই সময়ে দাতাদের আগের প্রতিশ্রুত ঋণ প্রাপ্তির অবস্থা হতাশাজনক; যে ঋণ পাওয়া গেছে, তার চেয়ে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) রবিবার চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) মোট ঋণ, প্রতিশ্রুতি ও সুদ-আসল পরিশোধসহ বিদেশি ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে।

তাতে দেখা যায়, এই পাঁচ মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ১৫৪ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার (১.৫৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই ঋণ গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশশিক শূন্য সাত শতাংশ কম।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ২১১ কোটি ৭০ লাখ (২.১১ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।

অন্যদিকে এই পাঁচ মাসে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১৭১ কোটি ১০ লাখ ৩০ হাজার (১.৭১ বিলিয়ন) ডলার। এর মধ্যে সুদ ৬৫ কোটি ৫১ লাখ ডলার। আর আসল ১০৫ কোটি ৫৯ লাখ (১.০৫ বিলি) ডলার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুদ-আসল বাবদ ১৩৩ কোটি ২২ লাখ (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। যার মধ্যে সুদ ছিল ৫৬ কোটি ২৩ লাখ ডলার; আসল ৭৭ কোটি ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-নভেম্বর সময়ে যতো ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে তার চেয়ে ১৬ কোটি ৭৩ লাখ ডলার বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। শতাংশ হিসাবে পরিশোধ বেড়েছে ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস থেকেই দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ পাচ্ছে তারচেয়ে তাদেরকে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ এখন যে ঋণ পাচ্ছে তার চেয়ে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ের শুরু থেকে দেশ উত্তাল হয়ে পড়ে। আর ওই মাসে বিদেশি ঋণ ছাড় হয় ৩৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।

পরের মাসে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। দুই দিন বাদে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা করে।

ওই মাসে বিদেশি অর্থ ছাড় হয় মাত্র ১০ কোটি ডলার। অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে দাতারা ৩৮ কোটি ৭৮ লাখ ডলার ছাড় করেছে। অক্টোবরে ছাড় করে ৩৫ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। সবশেষ নভেশ্বর মাসে ছাড় করেছে ৩৪ কোটি ১৭ লাখ ডলার।

এই পাঁচ মাসের প্রতি মাসেই যে বিদেশি ঋণ এসেছে, তার চেয়ে বেশি চলে গেছে আগের ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে।

এভাবে টানা পাঁচ মাস বিদেশি ঋণ পাওয়ার চেয়ে বেশি পরিশোধ করা দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

সাধারণত অর্থ ছাড়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কমই থাকে, আগের অর্থবছরগুলোতে চিত্র ছিল এমনটাই। তবে দেশের অস্থির সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ বিদেশি অর্থ এসেছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ চলে যাচ্ছে শোধ করতে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইআরডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার আসলে অতিপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাড়া অন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে না। সে কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তাবাংনের হারও হতাশজনক।”

তিনি বলেন, “দাতাদের কাছ থেকে আমরা কোনও উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতেই ঋণ চুক্তি করে থাকি। সেই চুক্তির আলোকেই ঋণ ছাড় করে তারা। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ চললে সেই কাজের বিপরীতে দাতারা অর্থ ছাড় করে। কিন্তু গত পাঁচ মাসে দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনও গতি নেই। বিদেশি ঋণনির্ভর কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না।”

“সরকার উল্টো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার দিকেই বেশি মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি ঋণ ছাড় কম হবে এটাই স্বাভাবিj,” বলেন ওই কর্মকর্তা।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মোট এডিপির মাত্র ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ খরচ হয়েছে।

এই অর্থবছরের এডিপির আকার ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

সবচেয়ে বেশি দিয়েছে এডিবি

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সবচেয়ে বেশি ৩১ কোটি ৮১ লাখ ১০ হাজার ডলার দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এডিবি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০ কোটি ৭৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার দিয়েছে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬ কোটি ১১ লাখ ডলার দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার দিয়েছে রাশিয়া।

অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার মধ্যে ২০ কোটি ৫৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ভারত ছাড় করেছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ২০ হাজার ডলার।

এই পাঁচ মাসে চীননের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার ডলার ঋণ। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ৪ কোটি ২৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ৯৮৯ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার (৯.৮৯ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি।

এর মধ্যে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ৩৩৫ কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার (৩.৩৫ বিলিয়ন) ডলার।

হিসাব করে দেখা যায়, গত অর্থবছরে মোট ঋণ-সহায়তার ৩৪ শতাংশ চলে যায় আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এর মধ্যে আসল ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। আর সুদ ছিল ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরের ৯২৬ কোটি ৬৮ লাখ (৯.২৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছিল ৯৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। আসল বাবদ শোধ করা হয়েছিল ১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।

প্রতিশ্রুতি তলানিতে

ইআরডি’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর নতুন করে ঋণ প্রতিশ্রুতি একেবারেই তলানিতে নেমে এসেছে। জুলাই-নভেম্বর—এই পাঁচ মাসে মাত্র ৫২ কোটি ২৬ লাখ ৮০ হাজার ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫৮৫ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার (৫.৮৬ বিলিয়ন) ডলার।

অবশ্য এ নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই বলে জানিয়েছেন ইআরডির কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বহুপাক্ষিক এবং দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী একাধিক খাতে বড় অঙ্কের ঋণ ও বাজেট সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।

সেগুলো পাওয়া শুরু হলে বিদেশি ঋণের প্রবাহ বাড়বে বলে জানিয়েছেন তারা।

রিজার্ভ আর কমবে না: গভর্নর পরবর্তী

রিজার্ভ আর কমবে না: গভর্নর

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর