৭ মাসে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে গেছে ২৯ হাজার কোটি টাকা

৭ মাসে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে গেছে ২৯ হাজার কোটি টাকা

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ মোটা অঙ্কের ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুত ঋণের মধ্যে এডিবি ৬০ কোটি ডলার ও বিশ্ব ব্যাংক ৫০ কোটি ডলার ছাড় করেছে। অন্য দাতা দেশ ও সংস্থাও কিছু ঋণ ছাড় করেছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৩৯৩ কোটি ৮৯ লাখ (৩.৯৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই ঋণ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশশিক ৪৫ শতাংশ কম।

তবে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ বেড়েই চলেছে; এই সাত মাসে ২৪১ কোটি ৮৯ লাখ (২.৪২ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। টাকার হিসাবে যা ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে পরিশোধ বেড়েছে ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ রাখা আছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সাত মাসেই (জুলাই-জানুয়ারি) ২৯ হাজার ৫ কোটি চলে গেছে বলে হিসাব দিয়েছে ইআরডি। 

গত অর্থবছরের বাজেটে এ বাবদ ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা করা হয়।

ডলারের দাম বাড়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ইআরডি’র কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২২ টাকা। অর্থাৎ এক ডলারের জন্য ১২২ টাকা খরচ করতে হয়েছে।

এক বছর আগে ২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৪৩৯ কোটি ৮৫ লাখ (৪.৪০ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা দিয়েছিল দাতা। বিপরীতে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ১৮৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলার (১.৮৫ বিলিয়ন) ডলার।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বিদেশি ঋণ পরিস্থিতির হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।

গত দুই মাস (ডিসেম্বর ও জানুয়ারি) বিদেশি ঋণ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ঋণ বেশি ছাড় হচ্ছে, সেই তুলনায় কম পরিশোধ করতে হচ্ছে। তার আগের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) প্রতি মাসেই যতো দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঋণ পেয়েছে, তারচেয়ে তাদেরকে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে।

ইআরডি’র তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট ১৭১ কোটি ১০ লাখ ৩০ হাজার (১.৭১ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। একই সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা দিয়েছিল ১৫৪ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার (১.৫২ বিলিয়ন) ডলার। তাতে অর্থ পাওয়ার চেয়ে ঋণ পরিশোধে ১৬ কোটি ৭৩ লাখ ডলার বেশি খরচ হয়ে।

তবে ডিসেম্বর শেষে (জুলাই-ডিসেম্বর) ঋণের অঙ্ক পরিশোধের চেয়ে বেশি হয়েছে। ওই ছয় মাসের হিসাবে, দাতাদের কাছ থেকে মোট ৩ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। সুদ-আসল বাবদ শোধ করা হয়েছে ১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার।

জানুয়ারি শেষে অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ারি সময়ে দাতাদের ঋণের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার; পরিশোধ করা হয়েছে ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।

ডিসেম্বরে এডিবির কাছ থেকে বাজেট সহায়তার ৬০ কোটি ডলার পাওয়া গেছে। বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ৫০ কোটি ডলার। এছাড়া আরও কয়েকটি দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কিছু ঋণ পাওয়া গেছে। এ কারণেই ছয় মাসের হিসাবে পরিশোধের চেয়ে ঋণের অঙ্ক বেড়ে যায়। জানুয়ারি শেষেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ মোটা অঙ্কের ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুত ঋণের মধ্যে এডিবি ৬০ কোটি ডলার ও বিশ্ব ব্যাংক ৫০ কোটি ডলার ছাড় করেছে। অন্য দাতা দেশ ও সংস্থাও কিছু ঋণ ছাড় করেছে।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের জুলাইয়ের শুরু থেকে দেশ উত্তাল হয়ে পড়ে। আর ওই মাসে বিদেশি ঋণ ছাড় হয় ৩৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।

পরের মাসে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। দুই দিন বাদে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা করে।

ওই মাসে বিদেশি অর্থ ছাড় হয় মাত্র ১০ কোটি ডলার। অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে দাতারা ৩৮ কোটি ৭৮ লাখ ডলার ছাড় করে। অক্টোবরে ছাড় করে ৩৫ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। নভেম্বর মাসে ছাড় করেছে ৩৪ কোটি ১৭ লাখ ডলার।

ডিসেম্বর মাসে বিশ্ব ব্যাংক-এডিবির বাজেট সহায়তার ১ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারসহ মোট ১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।

সবশেষ জানুয়ারি মাসে ৪০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার ছাড় করে দাতারা।

১২ বছরে পরিশোধ বেড়েছে তিন গুণ

বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। কারণ, কয়েক বছর ধরেই বিদেশি ঋণ পরিশোধ ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। পরের ১০ বছরে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ২০১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়।

২০২২-২৩ অর্থবছরে তা পৌনে তিন শ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ ৩৩৬ কোটি ডলার দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এর মানে গত এক যুগের বিদেশি ঋণ পরিশোধ তিন গুণ হয়েছে।

কয়েক বছর ধরেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। দুই বছর ধরে আরও বেশি বেড়েছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের এই চাপ শুরু হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে রিজার্ভ ও বাজেটে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

২৮ শতাংশই দিয়েছে এডিবি

ইআরডি’র তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১১০ কোটি (১.১০ বিলিয়ন) ডলারই দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

হিসাব বলছে, এই সাত মাসে মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৮৮ শতাংশই দিয়েছে এডিবি।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৬ কোটি ৭৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। মোট ঋণের ২২ শতাংশ দিয়েছে বৈশ্বিক আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থাটি। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৯ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার ডলার দিয়েছে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। রাশিয়া দিয়েছে ৫৩ কোটি ৬৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার।

অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার মধ্যে জুলাই-জানুয়ারি সময়ে চীনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ২৬ কোটি ৭৮ লাখ ১০ হাজার ডলার। ভারত ছাড় করেছে ৮ কোটি ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ৪ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ডলার।

প্রতিশ্রুতি কম ৬৭ শতাংশ

ইআরডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর নতুন করে ঋণ প্রতিশ্রুতি কমেছে। জুলাই-জানুয়ারি এই সাত মাসে ২৩৫ কোটি ৮ লাখ ৮০ হাজার (২.৩৫ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭১৭ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার (৭.১৭বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবে এই সাত মাসে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৬৭ দশমিক ২২ শতাংশ।

অর্থবছরের ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে প্রতিশ্রুতির অঙ্ক ছিল ২২৯ কোটি ৮৬ লাখ ৭০ হাজার (২.৩ বিলিয়ন) ডলার।

জুনের আগে মিলছে না আইএমএফের ঋণ পরবর্তী

জুনের আগে মিলছে না আইএমএফের ঋণ

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর