আইএমএফের ঋণ কি অনিশ্চিত
বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ সঙ্কটের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। কয়েক দফা আলোচনা শেষে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক সংস্থাটি। সাত কিস্তির এই ঋণের তিন কিস্তিতে ২.৩১ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি কিস্তিগুলো নিয়ে এখন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের বাকি কিস্তিগুলো পাওয়া অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ পাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত জানায়নি সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দল।
সংস্থাটি বলেছে, আগামী ২১ থেকে ২৬ এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংকের সদরদপ্তরে সংস্থা দুটির বসন্তকালীন বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হবে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলেই কেবল মিলবে ঋণের বাকি কিস্তিগুলো।
তিন কিস্তিতে ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার ইতোমধ্যেই ছাড় করেছে আইএমএফ। চতুর্থ কিস্তির ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাওয়ার কথা ছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। পরে তা পিছিয়ে মার্চ মাসে ছাড় করা হবে বলে জানিয়েছিল সংস্থাটি; সেটাও করেনি।
পরে জানানো হয় দুই কিস্তির অর্থ (চতুর্থ ও পঞ্চম) একসঙ্গে ছাড় করার বিষয়ে আলোচনা হবে। সেই আলোচনার জন্য গত ৫ এপ্রিল দুই সপ্তাহের সফরে ঢাকায় আসে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল।
সফর শেষ করে ওয়াশিংটন ফিরে যাওয়ার আগে বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের প্রধান আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, “এ বিষয়ে আলোচনা আরও চলবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হবে। এ বৈঠক হবে ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল।”
ওই বৈঠকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হলে দুই কিস্তির অর্থ (চতুর্থ ও পঞ্চম) আগামী জুনের শেষ দিকে এক সঙ্গে পাওয়া যেতে পারে বলে জানান তিনি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ আট মাস পার হয়েছে; এই সময়ে আইএমএফের কোনও ঋণ পায়নি বাংলাদেশ।
আইএমএফ তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করেছিল গত বছরের জুনে।
রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, বাংলাদেশের রিজার্ভের পাশাপাশি বিনিময় হারও স্থিতিশীল। রিজার্ভের পরিমাণ এমনকি তাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও নমনীয় হলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাড়বে।
কর ব্যবস্থা সংস্কারে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “করনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য থাকা উচিত। এ ছাড়া করছাড় কমাতে হবে, করনীতিকে সহজ করতে হবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধির টেকসই পথ খুঁজে বের করতে হবে।”
ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে আইনগত সংস্কার ও কার্যকর সম্পদ মান যাচাই এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন জোরদারের প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন পাপাজর্জিও। তিনি বলেন, “অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার জোরালো অগ্রগতি দরকার।”
ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি গত ৬ এপ্রিল থেকে বুধবার (১৭ এপ্রিল) পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ইত্যাদি দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
৬ এপ্রিল অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছিল আইএমএফ প্রতিনিধি দল। বুধবার (১৬ এপ্রিল) অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আরেক দফা বৈঠক করেন তারা।
এর আগে তিন কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে আইএমএফ মিশন এসেছিল। মিশন শেষে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি ‘স্টাফ লেবেল’ চুক্তি হয়েছিল। এটি আসলে কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে প্রাথমিক ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ। এবার এ ধরনের স্টাফ লেবেল চুক্তি হয়নি বলে জানা গেছে।
বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ সঙ্কটের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। কয়েক দফা আলোচনা শেষে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক সংস্থাটি।
এরপর তিন কিস্তির অর্থও পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। ওই বছরের ডিসেম্বরে পায় দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। আর গত বছরের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে।
তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে প্রায় ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের বাকি ২৩৯ কোটি (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার পাওয়ার কথা চার কিস্তিতে।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে পাপাজর্জিও বলেন, “আমরা সব সময় বিনিময়হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার কথা বলে থাকি। তবে বাংলাদেশকে এখনই পুরো বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি তেমন না। স্বল্পমেয়াদে বিনিময়হার বাজারভিত্তিক করার একটা ভালো সময় যাচ্ছে।
“কেননা, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল আছে। আগে নিয়মিতভাবে যা কমছিল। আবার ব্যাংক এবং খোলা বাজারে ডলারের দরে ব্যবধান অনেক কম। এ সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ব্যাপক বাড়ছে। দেশের মূল্যস্ফীতিও কমছে।
“অবশ্য জিডিপির তুলনায় এখনও মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আগামীতে এটা ৫ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। আর নীতি সুদহার বাড়ানো–কমানোর বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে।”
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর শর্তের বিষয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের কর–জিডিপি অনুপাতের ব্যবধান অনেক বেশি। জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আয় দীর্ঘদিন ধরে একই থাকছে। কখনো–কখনো কমে যাচ্ছে। এই অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করছাড় রয়েছে। আবার ভিন্ন–ভিন্ন করহার রয়েছে। এসব বিষয়ে সংস্কার আনতে হবে।”
ব্যাংকি খাতে খেলাপি ঋণের বিষয়ে এক প্রশ্নে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, “সরকার পরিবর্তনের পর খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আদায় ও তদারকি ব্যবস্থা জোরদারের মাধ্যমে এসব পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। এছাড়া পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে বাংলাদেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।”
কমেন্ট