পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নেই অনেক দিন

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নেই অনেক দিন

পুঁজিবাজারের যে বেহাল দশা তার জন্য বিদেশি বিনিয়োগের এই করুণ দশাও একটি কারণ বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। ফাইল ছবি

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। গত তিন বছর বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এক টাকাও বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। উল্টো অতীতে যে বিনিয়োগ এসেছিল, সেগুলোও বিক্রি করে দিয়ে টাকা দেশে নিয়ে যাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

পুঁজিবাজারের যে বেহাল দশা তার জন্য বিদেশি বিনিয়োগের এই করুণ দশাও একটি কারণ বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট বিনিয়োগের (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) পরিমাণ ছিল ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটি কমে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে নেমে আসে মাত্র ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। 

২০২০-২১ অর্থবছর শেষে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ২৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়। অর্থাৎ ওই বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যতো বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল, তার থেকে প্রায় ২৭ কোটি ডলার চলে যায়। 

২০২১-২২ অর্থবছরেও সেই ঋণাত্মক ধারা অব্যাহত থাকে; বছর শেষে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়। 

সর্বশেষ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই তথ্যই বলছে, গত আড়াই বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে নতুন কোনো বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। 

২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশে সার্বিক বিদেশি বিনিয়োগও নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। দুই বছরের করোনা মহামারির পর দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ডলারের পাগলা ঘোড়ার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে মোট ৪৫০ কোটি ৩০ লাখ (৪.৫০ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে দেশে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ কম। 

এই অর্থবছরে নিট এফডিআই-এর অঙ্ক ছিল ১৬১ কোটি ১০ লাখ (১.৬১ বিলিয়ন) ডলার; প্রায় ১২ শতাংশ। 

২০২১-২২  অর্থবছরের ৪৬৩ কোটি ৬০ লাখ (৪.৬৩ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট এফডিআই-এর পরিমাণ ছিল ১৮২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। 

তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট এফডিআই ছিল ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। 

ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের যে আবহ তৈরি হয়েছিল, তার প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগে পড়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পর ওলোটপালট হয়ে যায় বিশ্ব অর্থনীতি; পাল্টে যায় সব হিসাব-নিকাশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও সংকটের মধ্যে পড়ে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগও কমে গেছে।

তবে বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এফডিআই আবার বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। তখন পুঁজিবাজারেও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তারা। 

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “যেকোনো পুঁজিবাজারে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ থাকা ভালো। আমাদের বাজারেও তেমনটাই ছিল। কিন্তু ২০০৯-১০ সালে বাজারে বড় ধসের পর ৪-৫ বছর বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না বললেই চলে। ২০১৫ সাল থেকে কিছুটা আসতে শুরু করে। মাঝে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভালোই বিনিয়োগ করেছিল। ২০২০ সালে বাজারে যে একটা ধস হয়েছে সে আতঙ্কে অনেকে চলে গেছে। আর আসেনি।” 

এখন সামান্য যে বিদেশি বিনিয়োগ আছে, সেটা আগে বিনিয়োগ করা। বাজার সুস্থ-স্বাভাবিক না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবে না বলে জানান তিনি। 

বিদেশি বিনিয়োগের এই করুণ দশা নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী এআরএইচ ডটকমকে বাংলাকে বলেন, “২০২১ সালের প্রথমার্ধে কিছুদিন আমাদের বাজার ভালো ছিল। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছিল; বেশির ভাগ শেয়ারের দাম চড়া ছিল। ওই চড়া বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ করেনি। বরং মুনাফা তুলে নিতে হাতে থাকা শেয়ারগুলোই বিক্রি করে দিয়েছেন। এরপর থেকে বাজারে আর নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। সে কারণে নিট বিনিয়োগ অনেক দিন ধরে নেগেটিভ রয়েছে।” 

আন্তর্জাতিক বড় বড় বাজারের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসলে অনেক কিছু চিন্তা করে বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অডিটসহ স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, স্টক এক্সচেঞ্জের পারফর্মমেন্স ইত্যাদি।” 

“করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে আমাদের পুঁজিবাজার দুই মাসের বেশি বন্ধ ছিল। এটা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পছন্দ করেনি। মূলত সে সময়ের পর থেকেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করেনি।” 

তবে এখনো কয়েকটি ভালো কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে বলে জানান শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী। 

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হাসান বলেন, “প্রথম প্রথম যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন সেটা করেছেন মূলত ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। দেড় বছরের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ৮৬ টাকার ডলার এখন ১১০ টাকায় উঠেছে।”

“সব দেশেই ডলারের বাজার অস্থির থাকলে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়। কেননা, ডলারের দাম বেশি থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ার বিক্রি করেন তখন তারা আগের চেয়ে কম পরিমাণ ডলার নিয়ে যেতে পারেন। আমাদের বাজারে সেটাই হয়েছে।” 

“ডলারের দাম বাড়ায় নতুন কোনো বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ নিয়ে আসেনি। এর মধ্যেও কিছু বিনিয়োগ আসতে পারত। কিন্তু পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইজ থাকার কারণে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি,”বলেন এমরান হাসান। 

২০১০ সালের মহাধসের এক দশক পর ২০২০ সালের ১৭ মে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে চেয়ারম্যান করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়। এরপর বাজার চাঙা করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়। মাঝেমধ্যে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। 

দিন যত গেছে বাজারের অবস্থা ততই খারাপ হয়েছে। এখন অবস্থা খুবই খারাপ; লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। 

পুঁজিবাজারে লেনদেনে খরা চলছে। কমতে কমতে দেশের প্রধান বাজার ঢাকা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন ৪০০ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ডিএসইতে ৪৮৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৩ দশমিক ১৩ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৩২৯ দশমিক ৮৬ পয়েন্টে নেমে এসেছে। 

দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজারে প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের টানতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রোড শোর আয়োজন করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। কিন্তু তার কোনো ইতিবাচক ফল এখনো বাজারে পড়তে দেখা যায়নি।

ডিএসইতে দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম লেনদেন পরবর্তী

ডিএসইতে দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম লেনদেন

কমেন্ট