পুঁজিবাজারের পতনে বাজেট ‘উসিলা’, অর্থনীতির সংকটই বড় কারণ

পুঁজিবাজারের পতনে বাজেট ‘উসিলা’, অর্থনীতির সংকটই বড় কারণ

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারের এই দশার জন্য বাজেট উসিলা মাত্র। বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু লোক বাজেটকে উসিলা হিসেবে ব্যবহার করে কারসাজি করে বাজারের আরও পতন ঘটাতে চাইছে।

পুঁজিবাজারে দরপতন চলছেই। বাজেটের আগে যেমন সূচক পড়ছিল, কমছিল লেনদেন; তেমনি বাজেট পেশের পরও সেই দরপতন অব্যাহত রয়েছে।

বাজেট উপস্থাপনের পর প্রথম কর্মদিবস রবিবার দুই বাজারেই বড় দরপতন হয়; দ্বিতীয় কর্মদিবস সোমবারও বড় পতনের মধ্য দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। দুই বাজারেই মূল্যসূচকের পাশাপাশি লেনদেনও কমেছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারের এই দশার জন্য বাজেট উসিলা মাত্র। বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু লোক বাজেটকে উসিলা হিসেবে ব্যবহার করে কারসাজি করে বাজারের আরও পতন ঘটাতে চাইছে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে—শেয়ারের দাম আরও অনেক কমে গেলে, তারা কম দামে সেই শেয়ার কিনে বেশি মুনাফা করবে। কিন্তু আসল কারণ বাজেট নয়, দেশের অর্থনীতির সংকটই বাজারের এই বেহাল দশার জন্য দায়ি বলে মনে করছেন তারা।

গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন; তাতে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অর্জনের লক্ষ্য ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

পুঁজিবাজারে মন্দা কাটাতে কোনও দিক-নির্দেশনা ছিল না নতুন বাজেটে; উল্টো মূলধনি মুনাফা বা ক্যাপিটাল গেইনের ওপর ছিল করের প্রস্তাব। এই অবস্থায় বাজেট পেশের পর দরপতন অব্যহত রয়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে।

রবিবার প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৫ দশমিক ৭৬ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ২৫ শতাংশ কমে ৫ হাজার ১৭১ দশমিক ৫৬ পয়েন্টে নেমে আসে। অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১০৬ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট বা দশমিক ৭১ শতাংশ কমে ১৪ হাজার ৮৪০ দশমিক ৪৮ পয়েন্টে নামে।

সোমবার ডিএসইএক্স আরও ৬৫ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ২৬ শতাংশ কমে ৫ হাজার ১০৫ দশমিক ৮৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। বাজেটের পর দুই কার্যদিবসেই ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৩১ পয়েন্ট বা আড়াই শতাংশ কমে গেছে। ২০২১ সালের ৪ এপ্রিলের পর এটিই ডিএসইএক্স সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। ওই দিন ডিএসইএক্স সূচকটি ৫ হাজার ৮৯ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল।

সিএসই’র সার্বিক সূচক সিএএসপিআই সোমবার ১৬২ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ০৯ শতাংশ কমে ১৪ হাজার ৬৭৮ দশমিক ৩৬ পয়েন্টে নামে।

তবে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ডিএসইর বর্তমান পরিচালক ও সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বাজেট উসিলা মাত্র। বাজেট পেশের অনেক আগে থেকেই তো বাজার পড়ছে; মন্দা চলছে। আর এজন্য অনেক কারণ আছে। এখন বাজার খারাপের জন্য শুধু বাজেটকে দায়ি করা ঠিক হবে না।”

তিনি বলেন, “দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবও বাজারে পড়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। ডলারের দাম আরেক দফা বেড়েছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে বাজারে অস্থিরতা চলছে। এ অবস্থায় পুঁজিবাজার ভালো হবে—এমনটা আশা করা ঠিক হবে না।”

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, “বাজেটে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের বাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।কেননা, ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করেন এ রকম বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও হাতে গোনা। তা সত্ত্বেও বাজেটের এসব পদক্ষেপকে পুঁজি করে একটি গোষ্ঠী হয়তো কম দামে শেয়ার কেনার জন্য নানাভাবে ভীতি ছড়িয়ে বাজারে দরপতন ঘটাচ্ছে।

“নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত কারসাজির ঘটনা বন্ধ ও অনিয়ম রোধে তদারকি জোরদার করা। সেখানেই বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।”

দীর্ঘদিন ধরে দেশের পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে। ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীই হতাশ। অনেক বিনিয়োগকারী বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

বাজেটের পর দুই কার্যদিবসেই বড় ধরনের দরপতন হয়েছে পুঁজিবাজারে। তাতে ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৩১ পয়েন্ট বা আড়াই শতাংশ কমে গেছে। ২০২১ সালের ৪ এপ্রিলের পর এটিই ডিএসইএক্স সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। ওই দিন ডিএসইএক্স সূচকটি ৫ হাজার ৮৯ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল।

বাজেটের আগে ডিএসইসহ বাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দাবি ছিল, ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে নতুন করে যেন করারোপ করা না হয়। কিন্তু বাজেট প্রস্তাবে পুঁজিবাজারে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফায় কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, সেকেন্ডারি বাজারে শেয়ার লেনদেন করে কোনও বিনিয়োগকারী এক বছরে ৫৫ লাখ টাকা মুনাফা করলে তার ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত থাকবে, বাকি ৫ লাখ টাকা মুনাফা ওই বিনিয়োগকারীর মোট আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে।

তাতে ওই বিনিয়োগকারীর নির্দিষ্ট একটি অর্থবছরে তার মোট আয়ের ওপর যে হারে কর প্রযোজ্য হবে, সেই হারে কর দিতে হবে।

তবে কোনও বিনিয়োগকারী যদি কোনও শেয়ার একটানা ৫ বছর ধরে রেখে ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করে, সে ক্ষেত্রে ওই মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ হারে করারোপ হবে।

বাজার পরিস্থিতি

বাজেট পেশের আগে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স পড়তে পড়তে ৫ হাজার ২৫০ পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছিল। বাজেট প্রস্তাবের দিন বৃহস্পতিবার ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ২৩৭ দশমিক ৩২ পয়েন্ট।

দুদিন সাপ্তাহিক ছুটির পর রবিবার সেই সূচক ৬৫ দশমিক ৭৬ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ২৫ শতাংশ কমে ৫ হাজার ১৭১ দশমিক ৫৬ পয়েন্টে দাঁড়ায়। সেমবারও ডিএসইএক্স প্রায় একই পরিমাণ ৬৫ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ২৬ শতাংশ কমে ৫ হাজার ১০৫ দশমিক ৮৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে।

এক বছর আগে ৫ জুন ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ৩৫৬ দশমিক ৩০ পয়েন্ট।

হিসাব বলছে, এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএক্স কমেছে ১ হাজার ২৫০ পয়েন্টের বেশি।

সোমবার ডিএসই’র অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএস ১৭ দশমিক ১৬ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১০৩ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে। ডিএস-৩০ সূচক ২৩ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৮১১ দশমিক ৭৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৬২ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ০৯ শতাংশ কমে ১৪ হাজার ৬৭৮ দশমিক ৩৬ পয়েন্টে অেবস্থান করছে।

গত বছরের ৫ জুন সিএএসপিআই ছিল ১৮ হাজার ৭৭৬ দশমিক ৯৯ পয়েন্ট। এহিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক বছরে সিএএসপিআই কমেছে ৪ হাজার ১০০ পয়েন্ট।

সোমবার ডিএসইতে ৩৫৭ কোটি ৯০ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবস গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৫৪২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

ডিএসইতে ৩১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। রবিবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৩৫৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

এদিন ডিএসইতে মোট ৩৯১টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। লেনদেনে অংশ নেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে মধ্যে দর বেড়েছে বেড়েছে ২৬টির। কমেছে ৩৪০টির। আর অপরিবর্তিত ছিল ২৩টির দর।

সোমবার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে ২৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। রবিবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ১০৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

১০ কোটি ৭৮ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। বৃহস্পতিবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ১৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

২১৪টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ২২টির। কমেছে ১৬৭টির। অপরিবর্তিত ছিল ২৫টির দর।

‘গেইন ট্যাক্স’ প্রস্তাবের পর পুঁজিবাজারে বড় পতন পরবর্তী

‘গেইন ট্যাক্স’ প্রস্তাবের পর পুঁজিবাজারে বড় পতন

কমেন্ট