পুঁজিবাজার: বড় দরপতনে সপ্তাহ শুরু
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর কিছুদিন শেয়ারবাজারে সূচকের উল্লম্ফন হলেও একপর্যায়ে শেয়ারের দরপতন শুরু হয়। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
বিনিয়োগকারীদের হতাশা-ক্ষোভের মধ্যে বড় দরপতনে আরেকটি সপ্তাহ শুরু করল বাংলাদেশের পুঁজিবাজার।
সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার দেশের প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৮৩ দশমিক ৮০ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৩৭৮ দশমিক ৭৭ পয়েন্টে নেমে এসেছে। শতাংশ হিসাবে এই সূচক কমেছে ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
গত দুই মাসের মধ্যে এটিই ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। অর্থাৎ দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই সূচকটি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
ঢাকার বাজারের প্রধান সূচকটি সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট ৫ হাজার ২২৯ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। এরপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জেরে কয়েক দিনের বড় উত্থানে সূচকটি বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। এরপর দেখা দেয় উত্থান-পতন, তাতে ডিএসইএক্স সূচকটি কমে আবারও দুই মাস আগের অবস্থানে ফিরেছে।
অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১০৪ দশমিক ৫২ পয়েন্ট কমে ১৫ হাজার ১৬৭ দশমিক ২৫ পয়েন্টে নেমেছে।
আর এতে হতাশ ও ক্ষুব্দ বিনিয়োগকারীরা রবিবারও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সামনে বিক্ষোভ করেছেন। গত বুধ ও বৃহস্পতিবারের মতো রবিবারও তারা বিএসইসির চেয়ারম্যান খোন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
দরপতনের প্রতিবাদে রবিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একদল বিনিয়োগকারী মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ভবনের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় তারা পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক দরপতনের জন্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ভুল নীতিকে দায়ী করে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
পাশাপাশি তারা বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এই বিক্ষোভ হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর কিছুদিন শেয়ারবাজারে সূচকের উল্লম্ফন হলেও একপর্যায়ে শেয়ারের দরপতন শুরু হয়। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। এর মধ্যে বিএসইসিতে নতুন প্রশাসন কাজ শুরু করেছে, কিন্তু পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি।
৪ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ কর্মদিবসে ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল ৫ হাজার ২২৯ পয়েন্ট। সরকার পতনের পর চার কর্মদিবসে সূচক বাড়ে প্রায় আটশ পয়েন্ট।
সে সময় এক দিনে লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে ফেলে। ওই সময় যারা বিনিয়োগ করেছেন, তাদের সেই সিদ্ধান্ত এখন গলার কাঁটা হয়ে গেছে।
প্রাথমিক সেই উচ্ছ্বাস থেমে যাওয়ার পর ১২ অগাস্ট থেকে সূচক কমেছে ৭০০ পয়েন্টের মতো, বাজার মূলধন কমেছে ৪১ হাজার কোটি টাকা।
বিনিয়োগকারীরা এমনিতেই আস্থার অভাবে ভুগছিলেন, এমন সময়ে এক দিনে ২৮টি কোম্পানিকে জেড শ্রেণিতে নিয়ে যাওয়া হয় গত ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে। যেটি দরপতনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা।
পুঁজিবাজারে এই বেহাল দশার কারণ জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, ‘‘বিনিয়োগকারীরা টাকা হারাতে হারাতে তাদের আর জায়গা নেই। শুধু নীতি করলেই চলবে না, তাদেরও তো একটি আস্থার বার্তা দিতে হবে। এজন্য নীতি নির্ধারক পর্যায় থেকে একটি আশার বাণী আসা দরকার।”
“সবাই আশা করেছিলেন, সরকারের পট পরিবর্তনের পর বাজার ভালো হবে। তেমন আভাসও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিন না যেতেই সেই দরপতনের ধারায় ফিরেছে বাজার।”
বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ারবাজারে যে গতি ফিরেছিল, সেই গতি আবারও স্তিমিত হয়ে পড়েছে। শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আবারও চিড় ধরেছে। যার কারণে ব্যক্তিশ্রেণি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বাজারে অংশগ্রহণ কমে গেছে। তাতে শেয়ারের দরপতনের পাশাপাশি লেনদেনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। এ কারণে লেনদেন কমে ৪০০ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে।
ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে রবিবার সূচকের বড় পতনের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল ইসলামী ব্যাংকের। এদিন ব্যাংকটির শেয়ারের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা ৬ টাকা ১০ পয়সা দরপতনে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৪৪ পয়েন্ট। অর্থাৎ গতকাল ডিএসইএক্সের অর্ধেকের বেশি কমেছে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দরপতনের কারণে। ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও এদিন লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমেছে। ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৬টি ব্যাংকের মধ্যে ২৩টিরই দাম কমেছে। দাম বেড়েছে ৪টির আর অপরিবর্তিত ছিল ৯টির।
ব্যাংকের পাশাপাশি ভালো মৌলভিত্তির অন্যান্য শেয়ারেরও দরপতন হয়েছে, যা সূচকের পতনে বড় ভূমিকা রেখেছে। লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের তথ্য অনুযায়ী, স্কয়ার ফার্মার শেয়ারের ১ শতাংশ বা ২ টাকা ৪০ পয়সা দরপতনে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৬ পয়েন্টের বেশি। আর সিমেন্ট খাতের বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিমের শেয়ারের ৫ শতাংশ বা ৩ টাকা দরপতনে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৬ পয়েন্ট।
আর অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারের ৯ টাকা বা ৫ শতাংশের বেশি দরপতনে সূচক কমেছে ৫ পয়েন্ট। সব মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংক, স্কয়ার ফার্মা, লাফার্জহোলসিম ও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারের দরপতনে ডিএসইএক্স সূচক ৬১ পয়েন্ট কমেছে।
বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ এখন বাজারে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। দরপতন হতে থাকায় এসব বিনিয়োগকারী ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছেন। যার কারণে বাজারে ক্রেতাসংকট দেখা দিয়েছে। ক্রেতা না থাকায় বিক্রেতারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না।”
এ অবস্থায় দরপতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছেন বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের একটি দল আজ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন।
রবিবারের বাজার পরিস্থিতি
সপ্তাহের প্রথম দির রবিবার দুই বাজারেই মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। তবে লেনদেন সামান্য বেড়েছে।
রবিবার দিন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ৮৩ দশমিক ৮০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৩৭৮ পয়েন্টে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়া সূচক ৩০.৪১ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১৯০ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ২৬.৫৬ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৯৬৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
ডিএসইতে মোট ৩৯২টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ১৮০টি কোম্পানির, কমেছে ১৫৬টির এবং অপরিবর্তিত আছে ৫৬টির দর।
ডিএসইতে এদিন মোট ৩৬৮ কোটি ১৮ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবসে (বৃহস্পতিবার) লেনদেন হয়েছিল ৩১৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সিএসসিএক্স সূচক ৭১.৩৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৯ হাজার ২০৩ পয়েন্টে। সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১০৪.৫২ পয়েন্ট কমে ১৫ হাজার ১৬৭ পয়েন্টে, শরিয়া সূচক ১১.৬৭ পয়েন্ট কমে ৯৭৯ পয়েন্টে এবং সিএসই ৩০ সূচক ৮৯.৯৪ পয়েন্ট কমে ১২ হাজার ২৩৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
সিএসইতে ২০১টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে ১০০টি কোম্পানির, কমেছে ৮১টির এবং অপরিবর্তিত আছে ২০টির।
মতিঝিলে বিনিয়োগকারীদের মানবন্ধন
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগের দাবিতে রবিবারও মতিঝিলে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বিকেল পৌনে ৪টার দিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় তারা ‘অযোগ্য বিএসইসির চেয়ারম্যান হঠাও দেশের পুঁজিবাজার বাঁচাও’ স্লোগান দেন।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বলেন, খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে নেতৃত্বে বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস ছিল নতুন কমিশনের ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজার গতিশীল হবে। কিন্তু বিএসইসি চেয়ারম্যান না বুঝে সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে। যার কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই এখন আর তার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। তাই বিএসইসির চেয়ারম্যানকে পদত্যাগ করা খুবই জরুরি।
মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে সাধারণ বিনিয়োগকারীর পক্ষে বুলবুল আহমদে বলেন, “আমরা সকালে বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করেছি। তবে আমরা আমাদের এক দফা দাবিতে এখনও অনড় আছি। আমরা বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ চাই।”
কমেন্ট