পুঁজিবাজারে দরপতন চলছেই, ডিএসইতে ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন

পুঁজিবাজারে দরপতন চলছেই, ডিএসইতে ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর কিছুদিন পুঁজিবাজারে সূচকের উল্লম্ফন হলেও একপর্যায়ে পতন শুরু হয়। সেই ধারা এখনো চলছেই।

পুঁজিবাজারে দরপতন চলছেই। টানা পতনের মধ্যে চলতি সপ্তাহের চতুর্থ কর্মদিবস বুধবার দেশের দুই পুঁজিবাজারেই বড় পতন হয়েছে; লেনেদেন তলানিতে নেমে এসেছে।

প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন ৩০০ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে; লেনদেন হয়েছে ২৯৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। লেনদেনের এই অঙ্ক নয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর আগে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি এই বাজারে ২৯২ কোটি ১৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছিল।

লেনদেনের পাশাপাশি মূল্যসূচকও কমেছে। প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫০ পয়েন্টে কমে ৫ হাজার ৩১৬ পয়েন্টে নেমেছে। কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর।

অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) একই চিত্র দেখা গেছে। এদিন সিএসই’র সার্বিক সূচক সিএএসপিআই কমেছে ৭৫ পয়েন্টের বেশি; নেমেছে ১৪ হাজার ৯৭২ পয়েন্টে।

পূজার ছুটির পর সোমবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪৮ পয়েন্ট কমেছিল। দ্বিতীয় কর্মদিবস মঙ্গলবার কমেছিল ৭ পয়েন্ট।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা দরপতনে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। কিছু বিনিয়োগকারী রাগে-দুঃখে সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত কম-বেশি সব শেয়ারে ক্রেতা আছে। তবে সবাই সতর্ক। যারাই একটু-আধটু শেয়ার কিনছেন, তাদের প্রায় সবাই ঝুঁকি বিবেচনায় যতটা সম্ভব কম মূল্যে শেয়ার কেনার চেষ্টা করছেন। এতে শেয়ারের বিক্রির চেষ্টার বিপরীতে ক্রয় চাহিদা বাড়ছে না। ফলে শেয়ারদর কমছে; পতন হচ্ছেই বাজারে।

ইলেকট্রনিক শেয়ার ধারণ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সিডিবিএল প্রকাশিত তথ্যেও এর প্রমাণ মিলছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাসে সম্পূর্ণ খালি হওয়া বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যার তুলনায় নতুন বিও অ্যাকাউন্ট খোলার সংখ্যা কমছে। যেমন—এ সময়ে সাড়ে ১০ হাজারের বেশি বিও অ্যাকাউন্ট খালি হয়েছে। ফলে খালি হওয়া বিও সংখ্যা বেড়ে ৩ লাখ ২২ হাজারে উন্নীত হয়েছে, যা গত আগস্ট শেষে ছিল ৩ লাখ ৯ হাজার ৪৩৪টি। এ সময়ে নতুন খোলা ৮ হাজার ৬৩৮টি বিও অ্যাকাউন্টের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৯৮৭টিতে শেয়ার কেনা হয়নি।

টানা দরপতনকেই এ জন্য দায়ী করেছেন দেশের বড় একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বড় ও কৌশলী বিনিয়োগকারীরা এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগমুখী নন। এতে বাজারে ক্রয় চাহিদা কমে গেছে। এর বিপরীতে মার্জিন ঋণে কেনা শেয়ারে দর পতনে গ্রাহক নতুন করে অর্থ দিয়ে ঋণ সমন্বয় করছেন না।

“ফলে বাধ্য হয়ে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো ফোর্স সেল করছে, যা বাজারের দরপতনকে একরকম স্থায়ী রূপ দিচ্ছে।”

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর কিছুদিন পুঁজিবাজারে সূচকের উল্লম্ফন হলেও একপর্যায়ে পতন শুরু হয়। সেই ধারা এখনো চলছেই। এর মধ্যে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র নতুন চেয়ারম্যান খোন্দকার রাশেদ মাকসুদসহ নতুন নিয়োগ পাওয়া কমিশনাররা কাজ শুরু করেছে, কিন্তু পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি।

লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজের বিশ্লেষণ

ব্রোকারেজ হাউস লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে বুধবার সূচকের পতনের পেছনে যে পাঁচটি কোম্পানির সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল, তার মধ্যে দুটিই ব্যাংক। ব্যাংক দুটি হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক। এই দুটি ব্যাংকের শেয়ারের দরপতনে ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছে প্রায় ১২ পয়েন্ট। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের ১ টাকা ২০ পয়সা বা ২ শতাংশ দরপতনে ডিএসইএক্স সূচকটি সাড়ে ৮ পয়েন্ট ও ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারের ৮০ পয়সা বা দেড় শতাংশ দরপতনে সূচকটি সাড়ে ৩ পয়েন্ট কমেছে।

এই দুই কোম্পানি ছাড়া সূচকের পতনে আরও যে তিন কোম্পানির ভূমিকা ছিল, সেগুলো হলো রেনাটা, বীকন ফার্মা ও বেক্সিমকো ফার্মা। এ তিন কোম্পানির দরপতনে ডিএসইএক্স সূচকটি ১১ পয়েন্টের বেশি কমেছে।

শীর্ষস্থানীয় একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই এখন লেনদেনে নিষ্ক্রিয়। তাদের একটি অংশ লোকসানের কারণে চুপচাপ বসে আছেন। আরেকটি অংশ যাদের বিনিয়োগের সক্ষমতা আছে, তারা বিনিয়োগ না করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও নেই বললেই চলে। পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে রয়েছে।

এ অবস্থায় বাজারে বিনিয়োগের মতো সক্ষমতা ও বাস্তব অবস্থায় নেই এসব প্রতিষ্ঠান। আবার অতীতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে যেভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগে আনা হতো সে রকম চেষ্টাও এখন নেই। এ কারণে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সব পর্যায়ের বিনিয়োগে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে পড়ছেই বাজার।

বুধবারের বাজার পরিস্থিতি

বুধবার দিনশেষে ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ৪৯ দশমিক ৭৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৩১৬ পয়েন্টে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়া সূচক ১২ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১৮২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ডিএস৩০ সূচক ১৫ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৯৪৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

মোট ৩৯৫টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে মাত্র ৫৩টির। কমেছে ৩০০টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ৪২টির দর।

এদিন ডিএসইতে ২৯৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের দিন মঙ্গলবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৩১৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। এর আগে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ২৯২ কোটি ১৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছিল। সে হিসাবে ডিএসইতে গত ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে বুধবার।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সিএসসিএক্স সূচক ৪১ দশমিক ১৮ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৯ হাজার ১০২ পয়েন্টে। সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৭১ দশমিক ৫৬ পয়েন্ট কমে ১৪ হাজার ৯৭৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। শরিয়া সূচক ৬ দশমিক ৪১ পয়েন্ট কমে ৯৬৯ পয়েন্ট এবং সিএসই ৩০ সূচক ৩৮ দশমিক০৭ পয়েন্ট কমে ১২ হাজার ২০৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

পুঁজিবাজার পতনে বিক্ষোভ, বিএসইসির নিরাপত্তায় সশস্ত্র বাহিনী পরবর্তী

পুঁজিবাজার পতনে বিক্ষোভ, বিএসইসির নিরাপত্তায় সশস্ত্র বাহিনী

কমেন্ট