ডুবছে পুঁজিবাজার, দেখার কেউ নেই
সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার ডিএসইএক্স ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট হারিয়ে ৪ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৩৯ পয়েন্টে নেমেছিল। এ নিয়ে দুই দিনে ডিএসইএক্স ২১৬ পয়েন্ট কমেছে।
টানা দরপতনে ডুবতে বসেছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। লেনদেন শুরু হলেই পড়ছে সূচক। কেনো পড়ছে—তার কারণ উদঘাটনে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তবুও পতন থামছে না। ক্ষোভে-হতাশায় রাস্তায় নেমেছেন বিনিয়োগকারীরা।
সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার ধসের পর দ্বিতীয় দিন সোমবারও বড় দরপতন হয়েছে দুই বাজারে। এদিন প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৭ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৮৯৮ দশমিক ৫২ পয়েন্টে নেমে এসেছে। শতাংশ হিসাবে সোমবার ডিএসইএক্স কমেছে ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
এই সূচক চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২০ সালের ১১ নভেম্বরের এই সূচক ছিল ৪ হাজার ৮৬৬ পয়েন্ট।
অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৮৫ দশমিক ২৮ পয়েন্ট কমে ১৩ হাজার৮২১ দশমিক ৩১ পয়েন্টে নেমেছে। শতাংশ হিসাবে কমেছে ১ দশমিক ৩২ শতাংশ।
সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার ডিএসইএক্স ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট হারিয়ে ৪ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৩৯ পয়েন্টে নেমেছিল।
এ নিয়ে দুই দিনে ডিএসইএক্স ২১৬ পয়েন্ট কমেছে। রবিবার ধসের পর পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের কারণ অনুসন্ধানে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
কমিটির প্রধান করা হয়েছে সংস্থাটির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ শামসুর রহমানকে। অন্য সদস্যরা হলেন—বিএসইসির উপপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারিসুল হাসান রিফাত, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাহফুজুর রহমান এবং সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সহকারী মহাব্যবস্থাপক কাজী মিনহাজ উদ্দিন।
তদন্ত কমিটি গঠনসংক্রান্ত বিএসইসির আদেশে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার দরপতনের ধারায় রয়েছে। এই পতনকে অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে দরপতনের কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। এ জন্য গঠিত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
কমিটিকে বেশ কয়েকটি বিষয় খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। এ জন্য সুনির্দিষ্ট কার্যপরিধিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে—সাম্প্রতিক সময়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্সের টানা পতনের কারণ অনুসন্ধান, এ সময়ে বাজারে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে কোনো ব্যক্তি জড়িত রয়েছেন কি না—তা খুঁজে দেখা, দরপতনের পেছনে আকস্মিক কোনো ঘটনা রয়েছে কি না ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করবে কমিটি।
বিনিয়োগকারীরা আশা করেছিলেন, তদন্ত কমিটি গঠনের পর বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু তা না হয়ে দরপতনের ধারাতেই রয়েছে বাজার।
এদিকে পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন বিনিয়োগকারীরা। সোমবার রাজধানীর মতিঝিলে ডিএসইর পুরনো কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন তারা। রবিবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন করেছছিল।
এর আগেও কয়েক দিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ভবন ঘেরাও করে প্রতিবাদ জানিয়েছে তারা। তার পরও বাজারে পতন থামছে না। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নেওয়া হচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ। এতে তাদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিকভাবে দরপতন ঘটছে। বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়ার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “পতনের পর পতনে বাজারে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কিন্তু বিএসইসি বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। কিন্তু শেয়ার কেনার ক্রেতা কম। বিক্রির চাপেই মূলত বাজার পড়ছে।”
“বাজারে দরপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার। ভালো ব্যাংকগুলো এখন আমানতের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশের বেশি হারে সুদ দিচ্ছে; অন্যদিকে ট্রেজারি রেটও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর প্রভাবে পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ সরে গেছে এবং বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।”
“এছাড়া অর্থনীতিতে অস্থিরতা আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। সব মিলিয়ে বাজার বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।”
“অনেক বিনিয়োগকারী তাদের বিও হিসাব বন্ধ করে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন,” বলেন শাকিল রিজভী।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর পুঁজিবাজারে ব্যাপক উত্থান শুরু হয়। মূল্যসূচকের পাশাপাশি লেনদেনও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। টানা চার কর্মদিবসে (৬, ৭, ৮ ও ১১ আগস্ট) প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৮০০ পয়েন্টের মতো বেড়েছিল।
১১ আগস্ট ডিএসইএক্স ৯১ পয়েন্টের বেশি বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে ৬ হাজার ১৫ দশমিক ৯০ পয়েন্টে অবস্থান করছিল। লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
তবে ১২ ও ১৩ আগস্ট বাজার হোঁচট খায়; এই দুই দিনে ডিএসইএক্স প্রায় ১৫০ পয়েন্টের মতো পড়ে যায়; সূচক নেমে আসে ৫ হাজার ৮৬৭ দশমিক ৯৬ পয়েন্টে। লেনদেন নেমে আসে হাজার কোটি টাকায়।
এরই মধ্যে ১৩ আগস্ট অর্থনীতিবিদ পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তার নিয়োগের খবরে ১৪ আগস্ট দুই বাজারেই সূচক বাড়ে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ৮৪ দশমিক ৮১ পয়েন্ট। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক সিএএসপিআই বাড়ে ১৩২ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট।
মাসরুর রিয়াজের নিয়োগের পরপরই বিতর্ক ওঠার প্রেক্ষাপটে তার নিয়োগ স্থগিত রাখে সরকার। এ খবরে ১৫ আগস্ট দুই বাজারেই সূচকের পতন দেখা যায়। ডিএসইএক্স ৪৮ দশমিক ৯৩ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯০৩ দশমিক ৮৩ পয়েন্টে দাঁড়ায়।
এরই মধ্যে ১৬ আগস্ট পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান মাসরুর রিয়াজ। পদত্যাগের কারণ জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতিও দেন মাসরুর।
এমন পরিস্থিতিতে ১৮ আগস্ট দুই বাজারেই মূলসূচকের বড় পতন হয়েছে। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১২৫ দশমিক ১৯ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৭৭৮ দশমিক ৬৩ পয়েন্টে নেমে আসে।
মাসরুর রিয়াজ রাজি না হওয়ায় ১৮ আগস্ট পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের জন্য খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে নিয়োগ দেয় সরকার।
কিন্তু পুঁজিবাজারে পতন থামেনি। দু-একদিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই সূচক পড়েছে দুই বাজারে। লেনদেনেও খরা চলছে।
রবিবারের বাজার পরিস্থিতি
সোমবার ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৬ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৮৯৮ দশমিকট ৫৩ পয়েন্টে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়া সূচক ২০ দশমিক ২৭ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৮৭ দশমিক ৪৫ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ২৫ দশমিক ১০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৮০৫ দশমিক ৮৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
এদিন ডিএসইতে মোট ৩৯৭টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ১০৫টির। কমেছে ২৪৬টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ৪৬টির দর।
৩৫৭ কোটি ২৪ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। রবিবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৩০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
সিএসসিএক্স সূচক আগের দিনের চেয়ে ১১৯ দশমিক ০৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৮ হাজার ৪০৬ পয়েন্টে। সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৮৫ দশমিক ২৮ পয়েন্ট কমে ১৩ হাজার ৮২১ পয়েন্টে, শরিয়া সূচক ১৬ দশমিক ৪২ পয়েন্ট কমে ৮৯২ পয়েন্টে এবং সিএসই ৩০ সূচক ৯৫ দশমিক ৭৭ পয়েন্ট কমে ১১ হাজার ৫০৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
১৯২টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৫২টি কোম্পানির, কমেছে ১২৬টির এবং অপরিবর্তিত আছে ১৪টির দর।
দিনশেষে সিএসইতে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। রবিবার লেনদেন হয়েছিল ৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
কমেন্ট