পুঁজিবাজার টেনে তুলতে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের এনে সংস্কারের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

পুঁজিবাজার টেনে তুলতে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের এনে সংস্কারের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পুঁজিবাজারের উন্নয়নে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছেন। ছবি-পিআইডি

পুঁজিবাজার টেনে তুলতে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে এসে তিন মাসের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পাশাপাশি দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বহুজাতিক যেসব কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা রয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত পুঁজিবাজারে আনার জন্য দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন সরকার প্রধান।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এই প্রথমবারের মতো পুঁজিবাজার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিলেন।

রবিবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় পুঁজিবাজার নিয়ে অনুষ্ঠিত সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বৈঠকে অংশ নেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) আনিসুজ্জামান চৌধুরী, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রমুখ।

বৈঠক শেষে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন নির্দেশনার বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তিনি বলেন, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা পুঁজিবাজারের উন্নয়নে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনাগুলো হচ্ছে: ১. দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী যেসব বিদেশি বা বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা রয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত শেয়ারবাজারে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ২. গত ২০-৩০ বছরে দেশের বেসরকারি খাতে যেসব ভালো ও বড় বড় কোম্পানি গড়ে উঠেছে, সেগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে বাজারে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। ৩. বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ দল এনে তিন মাসের মধ্যে পুঁজিবাজার সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। ৪. পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৫. বড় বড় কোম্পানি যাতে ব্যাংকঋণ নেওয়ার বদলে পুঁজিবাজারে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহী হয়, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাংবাদিকদের শফিকুল আলম আরও বলেন, বৈঠকে বিএসইসি চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদ বাজারের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরেন। গত ৯ মাসে কী ধরনের সংস্কার করা হয়েছে, কোথায় কোথায় এখনো সংস্কার চলমান রয়েছে, সেগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। সেগুলো নিয়ে বৈঠকে প্রাণবন্ত আলোচনা হয়। তার আলোকে প্রধান উপদেষ্টা পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সরকারের মালিকানা রয়েছে এমন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে উদাহরণ হিসেবে ইউনিলিভারের নাম প্রধান উপদেষ্টার সামনে তুলে ধরা হয়। বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, ইউনিলিভারে সরকারের প্রায় ৪০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। সে জন্য প্রণোদনা দেওয়া হলে এ ধরনের কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনা সহজ হবে। এই পদক্ষেপ বাজারের উন্নয়ন ঘটাতে ও গভীরতা বাড়াতে সহায়ক হবে। সভায় এ নিয়ে ঐকমত্য পোষণ করা হয়।

সূত্র আরও জানায়, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করপোরেট করহারের ব্যবধান ১০ শতাংশ করা নিয়ে আলোচনা হয়। বলা হয়েছে, অতীতে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে করহারের ব্যবধান ১০ শতাংশ ছিল। তাতে স্কয়ার থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি ভালো মানের অনেক কোম্পানি বাজারে এসেছে। একই রকম করসুবিধা দেওয়া হলে ভবিষ্যতেও ভালো ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসতে আগ্রহী হবে।

আগামী বাজেটে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করহারের ব্যবধানে বাড়ানোর বিষয়ে বৈঠকে সবাই একমত হন। তবে করহারের ব্যবধানটি কত হবে, সে বিষয়ে সে ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

শেয়ারবাজারের সংস্কার উদ্যোগ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, এখানে অনেক ধরনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী রয়েছে। এ কারণে সংস্কার পদক্ষেপ নিলে অনেক সময় সেগুলো ঠিকভাবে কাজ করে না। তাই সংস্কার উদ্যোগগুলো যেন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে জন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয় এমন বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে তাদের দিয়ে কাজটি করাতে হবে।

সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন, বাজার অংশীজনদের মতামত ছাড়া সরকারের এই বৈঠক কতটা ফলপ্রসূ হবে? জবাবে শফিকুল আলম বলেন, “এটি ছিল সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সভা। আমরা আশা করি, সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে সবাই একটা শক্তিশালী শেয়ারবাজার দেখতে পাবেন।”

“সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, সবার স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে এমন একটি শক্তিশালী ও গতিশীল শেয়ারবাজার গড়ে তোলা। সেটি করা গেলে সবাই উপকৃত হবেন।”

শফিকুল আলম আরও বলেন, “অতীতে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাতে নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে। শেয়ারবাজারে অতীতে বড় ধরনের ডাকাতি হয়েছে। চোখের সামনে এটা হয়েছে, অনেক সাংবাদিক এগুলো নিয়ে লেখেনওনি। তাঁদের অনেকে হয়তো উপকারভোগী ওই গোষ্ঠীর অংশ হয়ে গিয়েছিলেন।”

“এবারের বৈঠকের মূল বার্তা হলো—দ্রুত ও অর্থপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়ন করা, যাতে সবাই উপকারভোগী হন,” বলেন তিনি।

দীর্ঘদিন ধরে মন্দা চলছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। সবাই প্রত্যাশা করেছিল ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ঘুরে দাাঁড়াবে বাজার; তেমন লক্ষণও দেখা দিয়েছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। পরের দিন ৬ আগস্ট দেশের প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ২০০ পয়েন্ট বাড়ে; শতাংশ হিসাবে বাড়ে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। লেনদেনও বাড়তে থাকে।

ডিএসই’র পাশাপাশি আরেক পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জও (সিএসই) চাঙাভাবে ফিরে আসে। ছুটতে থাকে দুই বাজার।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাত্র চার কার্যদিবসে ডিএসইএক্স প্রায় ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওই সময় লেনদেনও বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছিল।

কিন্তু এর পর আবার দরপতনের ধারায় ফেরে পুঁজিবাজার। নয় মাস পর এসে এখন বাজারের লেনদেন কমে নেমেছে ৩০০ কোটির ঘরে, আর সূচকও ১ হাজার পয়েন্টের বেশি কমে ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে।

পুঁজিবাজারের লেনদেন কমে গেলে তাতে বিনিয়োগকারীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে শুরু করে ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ বাজারের অংশীজনেরাও বড় লোকসানের মুখে পড়েন।

২০১০ সালের বড় ধসের পর থেকে পুঁজিবাজারের এমন পরিস্থিতিই চলছে। মাঝেমধ্যে অবশ্য কিছুটা উত্থান দেখা গেলেও সেটি স্থায়ী হয় না। যার কারণে হঠাৎ হঠাৎ আশার ঝিলিক দেখা গেলেও আবার হতাশার মুখোমুখি হতে হয় বিনিয়োগকারী ও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

সবশেষ বাজারে বড় পতন হয় গত ৭ মে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দামামায় ওই দিন বাংলাদেশের দুই পুঁজিবাজারে বড় পতন হয়। প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসই ১৫০ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৮০২ পয়েন্টে নেমে যায়। ওই সূচক ছিল প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৭০ পয়েন্ট কমে ১৩ হাজার ৫৯০ পয়েন্টে নেমেছে।

পরের দিন (৮ মে) অবশ্য বাজার ঘুরে দাঁড়ায়। ১১ মে রবিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুঁজিবাজার নিয়ে বৈঠকে বসছেন- এমন খবরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আতঙ্কের ধাক্কা সামলে দুই বাজারেই মূল্যসূচকের উত্থানের মধ্য দিয়ে লেনদেন শেষ হয়। ওইদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১০০ পয়েন্ট বাড়ে। সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই বাড়ে ১১৩ পয়েন্ট।

প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের খবরে ঘুরে দাঁড়াল পুঁজিবাজার, সূচক বাড়ল ১০০ পয়েন্ট পরবর্তী

প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের খবরে ঘুরে দাঁড়াল পুঁজিবাজার, সূচক বাড়ল ১০০ পয়েন্ট

কমেন্ট