যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহার বাড়ানোর মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহার বাড়ানোর মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল। ফাইল ছবি

আবারও নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি লাগাম টেনে ধরতে গত বছর থেকে ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে দেশটি। 

এ নিয়ে গত ১৬ মাসে মোট ১১ বার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সবশেষ ফেডারেল রিজার্ভ বৃহস্পতিবার নীতি সুদের হার শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়েছে, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে নীতি সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। 

দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ওলোটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতিতে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছিল; বেড়েছিল জাহাজ ভাড়া। যার ফলে ছোট-বড় সব দেশেই মূল্যস্ফীতির পারদ লাফিয়ে লাফিয়ে চড়তে থাকে। 

বাড়তে বাড়তে গত বছরের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশে গিয়ে উঠে। যা ছিল ৪০ বছর অর্থাৎ ১৯৮১ সালের নভেম্বর মাসের পর সর্বোচ্চ। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, চীন, ভারত ব্রাজিলসহ সব দেশেই মূল্যস্ফীতি পাগলা ঘোড়ার ছুঁটতে থাকে। 

গত মে মাসে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এক যুগ পর প্রায় দুই অংকের ঘরে, ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে ওঠে। তবে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির এই পাগলা গোড়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার।

এমনিতেই টাকার বিপরীতে ডলারের দর বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে; দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোয় তা আরও ব্যয়বহুল হয়েছে। বিদেশি মুদ্রার ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। তাই এভাবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহার বাড়ানোর মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশকে। 

যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি কমেছে, বাংলাদেশ বিপাকে 

মানুষকে স্বস্তি দিতে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের মত সব দেশই নীতি সুদহার বাড়ানোর পথ বেছে নেয়; সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে ভোক্তার চাহিদা কমানো হয়। এতে সফলতাও মিলেছে। প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতি কমেছে বিশ্ব আর্থিক খাতের দুই মোড়ল সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ তথ্য দিচ্ছে। 

দেরিতে হলেও একই পথ বেঁছে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশপাশি বাজারে টাকার প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ১ জুলাই থেকে সব ধরনের ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতাপূর্ণ বর্তমান সময়ে মুদ্রানীতি, সুদহার, ট্রেজারি বিল, রেপো রেট, রিভার্স রেপো রেট প্রভৃতি শব্দের কথা ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে। এসবের অর্থ, ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য অর্থনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট মানুষজনই কেবল বোঝেন। সাধারণ দৃষ্টিতে বলা যায়, উল্লিখিত শব্দরাজি এখন সামনে চলে এসেছে মূলত বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে, যাতে ব্যাংকগুলো বেশি সুদের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কম টাকা ধার করে। 

আরও সহজ করে বলা যায়, ঋণ হিসেবে নেওয়া সস্তা টাকাকে ব্যয়বহুল করে তোলাই সাম্প্রতিক  সময়ের বহুল উচ্চারিত সুদহার বৃদ্ধির মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের আশা, টাকার প্রবাহ কমলে আমদানিসহ অন্যান্য খাতে চাহিদাও কমবে। এতে করে ডলারের দামে অস্থিতিশীলতা ও তীব্র মূল্যস্ফীতির ধারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। 

অর্থনীতির তত্ত্ব অনুসারে যদি টাকা ধার করা বা ঋণের ব্যালেন্স বহন করা বেশি ব্যয়বহুল হয় তাহলে ভোক্তারা খরচ করবে কম। অর্থাৎ যখন ভোক্তার খরচ করার শক্তি কমে যাবে, তখন চাহিদাও কমে যাবে যা শেষ পর্যন্ত দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেবে। 

তবে অর্থনীতির এই তত্ত্ব মেনে সুদহার বাড়ালেই যে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে কিংবা ডলারের দামে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে সেটি বিশ্বাস না করাই ভালো। কারণ, অর্থনীতিশাস্ত্রের প্রথাগত অনেক তত্ত্ব ও সমাধান বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থায় কাজ করে না। এখানে ব্যাংক ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা, মূল্যবোধহীন ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও ধনিক শ্রেণি তোষণ করা নীতিপরিকল্পনায় সৃষ্টি হওয়া অর্থনৈতিক দুর্দশা ও মূল্যস্ফীতিকে অনেক নীতিপরিকল্পকই এক কথায় করোনাভাইরাস অথবা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে ধরে নেন। 

তারা সবার আগে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান, তারপর নীতি-পরিকল্পনা সাজান। যেমন- বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা এক-দেড় বছর আগে যখন ব্যাংক ব্যবস্থার সুস্থতা ফিরিয়ে আনা, অতিমুনাফাজীবী ব্যবসায়ী শ্রেণির দৌরাত্ম্য দমন এবং সস্তায়-সহজে ঋণ দিয়ে খেলাপি ঋণ না বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন তখন আমাদের অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা অর্থনীতিবিদদের তীব্র সমালোচনা করে সবকিছুর জন্য কোভিড-১৯ মহামারি এবং পরে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকেই দায়ী করেছিলেন। 

অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ১৮ জুন ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার নিজোই স্বীকার করেছেন, এক দশকের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাজার সিন্ডিকেটের পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব এবং ৩ বছর ধরে ৯ শতাংশ সুদের হারের সীমাই বড় ভূমিকা রেখেছে।

বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ২০২২ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তার মূল তহবিলের সুদহার ১১ বার বাড়িয়েছে, যা এখন ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত ১৪ মাসে ১০ বার নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশটি রেকর্ড মূল্যস্ফীতির হারকে অনেকটাই বশে আনতে পেরেছে। 

২০২২ সালের মার্চ মাসে ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার ছিল শূন্যের কাছাকাছি। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রায় ৯ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছায়। সেই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার বাড়াতে বাড়াতে এখনকার ৫ দশমিক ৫০ শতাংশের সীমায় নিয়ে এসেছে। 

এতে করে দেশটির বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ২০২৩ সালের জুনে এসে ৩ শতাংশে নেমেছে, যা ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে সর্বনিম্ন। দেশটির অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফেডারেল রিজার্ভের নির্ধারিত ২ শতাংশের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হতে আরও সময় লাগবে। তাই ফেডারেল রিজার্ভ কিছুদিন পর আবারও নীতি সুদহার বাড়ানোর আভাস দিয়ে রেখেছে। 

পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে গত মে মাসের ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ২০ বেসিস পয়েন্ট কমে জুনে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪৯ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ হয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৩৬ বেসিস পয়েন্ট কমে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৬ শতাংশ। কিন্তু পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির হার জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে, যা গত বছরের মে মাসে ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। 

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সুদের হার বৃদ্ধি করলেও সদ্য শুরু হওয়া অর্থবছরে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর উচ্চমূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য তাদের করা ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন খুবই কঠিন হবে। অথচ বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম কমার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের উচ্চমূল্যস্ফীতির হারও অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে মুদ্রার জোগান নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিলেও কিছুদিন আগে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দফায় দফায় বাজারে মুদ্রা সরবরাহ করেছে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে বাজারে ছাড়া হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ ছাপানো টাকা। গত বছরের জুলাই-নভেম্বরে বাজারে নগদ ছাড়া হয়েছে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা।

অর্থনীতির এই দুর্দিনে আমাদের বিজ্ঞ নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই বোঝেন যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার অবশ্যই বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। আর মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগ খাতে সুদের হার বাড়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবকে ইতিবাচক করতে হলে ব্যাংক ব্যবস্থায় সুস্থতা ফিরিয়ে আনা, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করে সময় সময় বিপুল মুনাফা কামিয়ে নেওয়ার ধারা বন্ধ করা, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ-শৃঙ্খল উন্নতকরণ, বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন, যথাসময়ে পণ্য আমদানিতে দক্ষতা, উৎপাদকদের ন্যায্যমূল্য প্রদান, সঠিক সময়ে সার-বীজ ও সেচের ব্যবস্থাসহ বাজার ব্যবস্থাপনায় সময়োপযোগী পারদর্শিতা দেখাতে না পারলে দিনশেষে এই উদ্যোগ কোনো সুফল দেবে না। 

ডলার আরও ব্যয়বহুল হবে

যুক্তরাষ্ট্রে নীতি সুদহার বৃদ্ধির আরেকটি ফল হচ্ছে, সে দেশে বন্ডসহ অন্যান্য আমানতের সুদহার বৃদ্ধি পায়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। তারা তখন ভাবেন, ডলারে বিনিয়োগ করা ভালো। কারণ, এর ফলে ভালো সুদ পাওয়া যাবে। ফলে ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যায়। দেশে দেশে স্থানীয় মুদ্রার দরপতন হয়। 

গত এক বছরে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয়বহুল হয়েছে, পরিণামে অবধারিতভাবে বেড়েছে মূল্যস্ফীতির হার। আবার যেসব কোম্পানির নেট দায় ডলারের সাপেক্ষে নির্ধারিত হয়, তাদের মুনাফা কমবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় যে পদক্ষেপ নেয়, তার জেরে অনেক দেশে উল্টো মূল্যস্ফীতি বাড়ে। 

উঠতে-বসতে বাংলাদেশে সেটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত দেড় বছরে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে মার্কিন মুদ্রা ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। দেড় বছর আগে ১ ডলারের জন্য যেখানে ৮৪ টাকা খরচ করতে হত; এখন সেখানে ১০৯ টাকা লাগছে। 

এই যে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অংকের ঘরে উঠেছে, তাতে মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অন্যতম প্রধান কারণ বলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। 

সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ডলারের দাম আরও বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও। ফলে এ দেশেও ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে। ডলার সংকট মোকাবিলায় বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এ খাতে আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। উল্টো খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র দফায় দফায় নীতি সুদ হার বাড়ানোর ফলে স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও সুদের হার বাড়িয়ে ডলারকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৬ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার এখন বেড়ে ৫ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে। দেড় বছর আগে এর সুদের হার ছিল ১ শতাংশের কম। 

এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ডলারের দাম বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়িয়ে এখন গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এ হার গত বছরের শুরুতে এক শতাংশের নিচে ছিল। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর এপ্রিল থেকে তাদের নীতি সুদের হার বাড়তে থাকে। 

যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আগামীতে এ হার আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। চলতি বছরের মধ্যে এ হার আরও দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে। 

এর প্রভাবে আন্তর্জাতিকভাবেই ডলারের দাম আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলও (আ্ইএমএফ) ডলারের দাম আরও বাড়ার আভাস দিয়েছে। 

এ বিবেচনায় আমদানিতে কিছুটা শিথিলতা দেখাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপও বেশি। ফলে আগামীতে ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে। 

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদের হার বাড়ানোর ফলে বৈদেশিক ঋণের সুদের হারও বেড়ে যাবে। ফলে দেশ বৈদেশিক ঋণ কম নেবে। এছাড়া মুডিস ও এসএন্ডপি গ্লোবাল সম্প্রতি বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণমান কমানোর ফলে এখন ঋণও কম মিলবে। যেগুলো পাওয়া যাবে তার বিপরীতে বাড়তি সুদ দিতে হবে। 

রিজার্ভ আরও কমেছে

এদিকে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমছেই। 

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভ। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।  

এক সপ্তাহ আগে ১৯ জুলাই ‘গ্রস’ রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।  

দুই সপ্তাহ আগে ১২ জুলাই ‘গ্রস’ রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।  

এই দুই হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমেছে প্রায় ৩০ কোটি ডলার।  

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো নিয়ে সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে রিজার্ভের হালনাগাদ এই তথ্য পাওয়া গেছে।

গত মে মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২৩ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।  

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। 

গত ১৩ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।    

১৩ জুলাই ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।   

দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাব করতে বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিল।      

কিন্তু বাংলাদেশ সে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।   

ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।     

বাাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের সেই শর্ত বা পরামর্শ মেনেই এখন রিজার্ভের দুই ধরনের তথ্যই প্রকাশ করছে। 

সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তা সহসা কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। আর জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে যে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে, তা যদি সংঘাতে রুপ নেয় চলমান সংকট আরও ঘণীভূত হবে।

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমবে, প্রবৃদ্ধি  কমে হবে ৩ শতাংশ: আইএমএফ পরবর্তী

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমবে, প্রবৃদ্ধি কমে হবে ৩ শতাংশ: আইএমএফ

কমেন্ট