রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি: ৬ হাজার কোটি টাকা আয় বাংলাদেশ ব্যাংকের

রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি: ৬ হাজার কোটি টাকা আয় বাংলাদেশ ব্যাংকের

সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর রিজার্ভ থেকে এই ডলার বিক্রি করে ছয় হাজার কোটি টাকা আয় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। রিজার্ভ কমছেই; ২৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। 

দুই বছর আগে ২০২১ সালের আগস্টে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এই রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। এক বছর ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে সেই রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছর জুড়েই (২০২২ সালে ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) বাংলাদেশে ডলারের তীব্র সংকট ছিল। চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ডলার মিলছিল না। বাজার স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করেছে। 

সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর রিজার্ভ থেকে এই ডলার বিক্রি করে ছয় হাজার কোটি টাকা আয় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এই প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আয়, ব্যয় ও মুনাফার তথ্যও জানা যায়। 

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সভায় সভাপতিত্ব করেন। 

সব মিলিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার রেকর্ড আয়

বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারকে দেওয়া প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ঋণ এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে বিনিয়োগ থেকে আয় বাড়ায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক রেকর্ড ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেছে; যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৪৮ শতাংশ বেশি। 

বিপুল এ আয় থেকে ব্যয় ও কর দেওয়ার পর গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট মুনাফা হয় ১০ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় ছিল ছয় হাজার ২৯ কোটি টাকা এবং মুনাফা ছিল পাঁচ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের আয় ও মুনাফা উভয় ক্ষেত্রেই তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ‘‘নিট মুনাফা ১০ হাজার ৭৪৮ কোটির টাকার মধ্যে ১০ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে।” 

এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ আট হাজার ৬০৮ কোটি টাকা আয় হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে। তার আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যা ছিল সাত হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। 

মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক হিসাবের প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়েছে বলে জানান মুখপাত্র। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে সরকারকে দেওয়া ঋণের সুদ থেকে সাত হাজার কোটি টাকা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংককে দেওয়া ঋণের সুদ হিসেবে দুই হাজার কোটি টাকা আয় করেছে। 

অপরদিকে রিজার্ভ থেকে বিদেশি মুদ্রা বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছে ছয় হাজার কোটি টাকা। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে মোট ঋণ নেয় এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়েছিল ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। 

এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার ও বাণিজ্যিক ব্যাংককে দেওয়া ঋণ থেকে সুদের আয় ছিল তিন হাজার ১০ কোটি টাকা এবং বিদেশি মুদ্রা খাতে বিনিয়োগ থেকে দু্ই হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। 

আগের অর্থবছরের থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয়ে যেমন উল্লম্ফন হয়েছে (১৪৮ শতাংশ বেড়েছে), তেমনি মুনাফাতেও। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট ‍মুনাফা ছিল তিন হাজার ১৭১ কোটি টাকা। 

সে হিসাবে আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট মুনাফা বেড়েছে সাত হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা বা ২৩৯ শতাংশ। 

মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদের বৈঠকে অর্থপাচার প্রতিরোধে আমদানিতে বৈশ্বিকভাবে পণ্যের প্রকৃত মূল্য জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকে ব্লুমবার্গের একটি টার্মিনাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

বৈঠকে রিজার্ভ থেকে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশকে দেওয়া অর্থের সুদহার লাইবর রেট এর বদলে বাংলাদেশ ব্যাংক র্নিধারিত ‘বেঞ্চমার্ক পদ্ধতি’ অনুসরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

এছাড়া ব্যাংক বর্হিভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স পাওয়া নগদ ফাইন্যান্সের ‘লাইসেন্স সমপর্ণ’ বৈঠকে গ্রহণ করা হয়। গত ১৭ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চূড়ান্ত লাইসেন্স পাওয়ার পর ব্যবসা শুরুর আগেই কোম্পানিটি লাইসেন্স সমপর্ণ করেছে। 

নতুন এ লাইসেন্স পাওয়া নগদ ফাইন্যান্সে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানি নগদ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির আহমেদ মিশুক একজন পরিচালক হিসেবে আছেন।

 

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাজারে ডলারের জোগান ঠিক রাখতে ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় প্রায় দ্বিগুণ, ১৩  দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। 

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেড় মাসে (১ জুলাই  থেকে ১৫ আগস্ট) দেড় বিলিয়ন ডলারের মত বিক্রি ককরা হয়েছে বলে জানা গেছে।  

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে অবশ্য বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

রিজার্ভ যেনো আর না কমে 

২০২১ সালের আগস্টে যে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়েছিল তাতে বাজার থেকে ডলার কেনার অবদান ছিল। আর বর্তমানে রিজার্ভ যে কমছেই, তাতেও গত অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি একটি কারণ বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। 

এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা সবচেয়ে বড় যে ভুলটি করেছিলাম, সেটি হলো, দীর্ঘদিন ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ডলারের দর জোর ‘ধরে’ রাখা হয়েছিল। তার মাশুল প্রতিদিন আমাদের দিতে হচ্ছে। এখনও দিতে হচ্ছে। জানি না কতদিন দিতে হবে?” 

“যুদ্ধ এখনও চলছে; ডলার সংকট এখনও  কাটেনি। সে কারণে রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে ঋণসহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। যেসব ঋণ পাইপলাইনে আটকে আছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় করাতে দাতাদের সঙ্গে দেন-দরবার করতে হবে।”  

“এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, রিজার্ভ যেনো কোনো অবস্থাতেই আর না কমে। রিজার্ভ আরও কমবে সংকট আরও বাড়বে। সেজন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর। 

মঙ্গলবার দিন শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভ। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। 

গত ১২ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।    

ওই দিন ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। 

এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত দেড় মাসে ‘গ্রস’ রিজার্ভ ৬০ কোটি ডলারের মত। 

সবশেষ গত জুনে মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২৩ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।  

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহার বাড়ানোর মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে পরবর্তী

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহার বাড়ানোর মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে

কমেন্ট