সেই শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন ১.২%, বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ

সেই শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন ১.২%, বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ

গত বছরের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কায় পণ্যের উচ্চমূল্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাতে পোড়া পাউরুটি হাতে এক প্রতিবাদকারী। ছবি: এএফপি

বেশি দিন আগের কথা নয়; এক বছর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছিল। অবিশ্বাস্য তথ্য হচ্ছে—অক্টোবরে সেই মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

অর্থাৎ এক বছরের মাথায় বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক ৬৮ দশমিক ৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে এনেছে দ্বীপদেশটি।

অথচ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি চড়ছে। গত বছরের অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ; এই অক্টোবরে তা বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশ—৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে উঠেছে।

এমনকি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে নাজেহাল পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতিও নিম্মমূখি হয়েছে। গত এপ্রিলে দেশটির মূল্যস্ফীতি প্রায় ৫০ শতাংশে উঠেছিল। অক্টোবরে তা ৩১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান নয়, বিশ্বের সব দেশের মূল্যস্ফীতির পারদই কমছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সোমবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।

আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। যা ছিল এক যুগ বা ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

সেপ্টেম্বরে অবশ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিম্মমূখী হয়। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমে আসে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি নামে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশে।

অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশে—৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে উঠেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

অক্টোবর মাসে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের অক্টোবরে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের অক্টোবরে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৩ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

আর ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের অক্টোবরে মাসে দেশের মানুষ যে খাদ্য ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের অক্টোবরে তা কিনতে ১১২ টাকা ৯৩ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত শ্রীলংকা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি আরও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।

অক্টোবরে দেশটিতে এ হার ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে; সেপ্টেম্বরে যা ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ। আগের মাস আগস্টে ছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ হার গিয়ে চড়েছিল রেকর্ড ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে।

মূল্যস্ফীতির বাড়বাড়ন্তের কারণে গত বছর শ্রীলংকার অর্থনীতির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়। চরমে পৌঁছায় জ্বালানি সংকট। পেট্রল পাম্পগুলোয় অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জন-অসন্তোষ চরমে ওঠে।

দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যেও মিলছিল না খাদ্য ও জ্বালানি। রিজার্ভ সংকটে দেউলিয়া শ্রীলংকার জন্য গত বছর আরো বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল মূল্যস্ফীতি। এ অবস্থা থেকেও দেশটি ফিরে এসেছে বিস্ময়করভাবে।

দুর্দশাগ্রস্ত শ্রীলংকার এ ঘুরে দাঁড়ানো রূপকথার গল্পের মতো শোনালেও অর্থনীতির প্রচলিত নীতির কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমেই এই অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিয়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

শ্রীলঙ্কার এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ৬৩ বছর বয়সী নন্দলাল বীরাসিংহে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে তিনি কয়েক বছর আগেই শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করেছিলেন। তখন তিনি শ্রীলঙ্কার উপগভর্নর ছিলেন। কিন্তু তখন তার সতর্কবার্তাগুলো দেশটির সরকার আমলে নেননি।

এমন অবস্থায় আগাম অবসর নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান নন্দলাল। তবে গত বছর শ্রীলঙ্কা চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়ার পর দেশটিকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের জন্য আবারও তাকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বলা যায়, নন্দলাল বীরাসিংহের নেতুত্বেই শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে কাটিয়ে উঠছে; ৭০ শতাংশে উঠে যাওয়া মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

শ্রীলংকার শুমারি ও পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ছিল ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে এটি কমে ৪৩ দশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়ায়। গত মার্চে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ। এপ্রিলে এটি আরো কমে দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৮ শতাংশে। এর পরের মে মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। গত জুনে মূল্যস্ফীতি এক অংকে নেমে আসে, যা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।

জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। আগস্টে এই সূচক আরও কমে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়।

গত সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ। সর্বশেষ অক্টোবরে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশে।

বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার এক যুগ বা ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়স সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামীলীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনও মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছিল। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি চড়তে থাকে। এখনও যা বেড়েই চলেছে।

শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি কমে আসার বিষয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, যথাযথ নীতি পদক্ষেপ নেয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং মধ্যম মেয়াদে তা লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে। তবে সরকারের মূল্য বেঁধে দেয়া, ট্যারিফ কিংবা কর বাড়ানোর কারণে সাময়িকভাবে স্বল্পমেয়াদে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।

মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানতে এ বছরের মার্চ ও এপ্রিলে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগ্রাসীভাবে নীতি সুদহার ১ হাজার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছিল। যদিও এর পরের মাসগুলোয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসায় সুদহার কমিয়েছিল দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসায় বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছে দেশটি। এরই মধ্যে দেশটির রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত পর্যটন থেকেও আয় বাড়ছে। স্থানীয় মুদ্রাও কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে। পাশাপাশি ধীরে ধীরে দেশটি বৈদেশিক ঋণ শোধ করে দিতে শুরু করেছে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশের কাছ থেকে নেয়া ২০ কোটি ডলারের ঋণ সুদসহ পরিশোধ করে দিয়েছে দেশটি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের প্রভাব ছাড়াই যাতে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে সে উদ্যোগও নিয়েছে। দেশটির মনিটারি বোর্ডে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি থাকত। ফলে মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের প্রভাব রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু আইন পরিবর্তন করে বোর্ডে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে তারা আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে, যেটি মূল্যস্ফীতি কমাতেও ভূমিকা রেখেছে। একসময় দেশটির রিজার্ভ মাত্র ২৫ মিলিয়ন (২ কোটি ৫০ লাখ) ডলার ছিল, যেখান থেকে সেটি বেড়ে ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। এটিও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছে।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “গত এক বছরে শ্রীলঙ্কা যেভাবে তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে সেটি বিস্ময়কর। মূলত দেশটি সামষ্টিক অথনৈতিক নীতি সমন্বয়ের মাধ্যমেই এটি করতে সক্ষম হয়েছে।”

“তারা যেসব নীতি গ্রহণ করেছে সেগুলো অর্থনীতির একেবারেই প্রচলিত নীতি বলা যায়। সেখানে তারা মুদ্রনীতি কঠোর করেছে। মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে তারা গত বছরের শুরু থেকে এ বছর পর্যন্ত প্রায় ৯০০ বেসিস পয়েন্ট নীতি সুদহার বাড়িয়েছে।”

আগে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে সহায়তা করতে পারবে এমন আইন ছিল। কিন্তু বর্তমান গভর্নর এসে এ আইন পরিবর্তন করে সরকারকে টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেয়ার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন।”

তিনি বলেন, ‘একদিকে তারা করপোরেট কর, ব্যক্তিগত কর বাড়িয়েছে, অন্যদিকে ব্যয় কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এতে করে দেশটির বাজেট ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কমেছে। মুদ্রা বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর্থিক খাতে সংস্কার করা হয়েছে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য “

“শ্রীলংকার ব্যাংক খাতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশই ছিল সরকারের ট্রেজারি বিল। এ নির্ভরতা কমিয়ে আনার জন্যও দেশটি সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণও এক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। সব মিলিয়েই শ্রীলংকা অর্থনৈতিক দুর্যোগ সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।

‘তাহলে দাম বেঁধে দিয়ে লাভ কী’ পরবর্তী

‘তাহলে দাম বেঁধে দিয়ে লাভ কী’

কমেন্ট