ডলারে তছনছ অর্থনীতি

ডলারে তছনছ অর্থনীতি

‘অস্থির’ ডলারের বাজার ‘সুস্থির’ করতে নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বেড়েই চলেছে ডলারের দর; দুর্বল হচ্ছে টাকা।

দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রধান সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরছিল। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্টোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশের উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগের ছক কষছিলেন।

কিন্তু পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব ওলোটপালট করে দেয়। পাল্টে যাচ্ছে সব হিসাব নিকাশ। বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও তছনছ হয়ে যাচ্ছে। পাগলা ঘোড়ার মত ছুঁটছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার।

দেড় বছর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর বাড়তে থাকে ডলারের দর; টানা বাড়তে বাড়তে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেই এখন ১১১ টাকা উঠেছে। ব্যাংকগুলো ১১৫/১১৬ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করছে; প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিটেন্স সংগ্রহ করছে ১২৪ টাকায়।

আর এ সবের ধাক্কায় বৃহস্পতিবার খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১২৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

‘অস্থির’ ডলারের বাজার ‘সুস্থির’ করতে নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বেড়েই চলেছে ডলারের দর; দুর্বল হচ্ছে টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের অক্টোবরে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ দুই বছর আগে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে প্রতি ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৮০ খরচ করতে হতো। বৃহস্পতিবার লেগেছে ১১১ টাকা।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই দুই বছরে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার মান কমেছে ৩১ শতাংশ।

এর অর্থ হলো ২০২১ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কোনো পণ্য বা সেবা আমদানি করতে যে ডলারের প্রয়োজন তা কিনতে ১০০ টাকা লাগতো, বর্তমানে তার জন্য ১৩১ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।

বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি যে প্রায় ১০ শতাংশে উঠেছে, তাতে ডলারের এই উল্লম্ফন অন্যতম প্রধান একটি কারণ বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

২০২১ সালের ৫ আগস্ট থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। আমদানি বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় শক্তিশালী হতে থাকে ডলার; বিপরীতে কমতে থাকে টাকার মান। এখনও তা অব্যাহত আছে।

মূল্যস্ফীতি এক যুগে সর্বোচ্চ

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সবশেষ হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা এক যুগ বা ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

অক্টোবর মাসে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের অক্টোবরে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের অক্টোবরে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৩ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

আর ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের অক্টোবরে মাসে দেশের মানুষ যে খাদ্য ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের অক্টোবরে তা কিনতে ১১২ টাকা ৫৬ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

রিজার্ভ উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে

শুধু মূল্যস্ফীতি নয়, ডলারের উল্লম্ফনের প্রভাব অর্থনীতির সব খাতেই পড়েছে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমতে কমতে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। কিন্তু এরপর থেকে কমছেই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।

আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপ নিয়েও রিজার্ভের পতন আর ঠেকানো যায়নি। উল্টো দিন যতো যাচ্ছে, রিজার্ভ কমছেই।

সবশেষ গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওইদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।

গত ৭ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

সবশেষ গত আগস্ট মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। তার আগে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) নিম্মমূখী।

এ পরিস্থিতিতে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ না পাওয়া পর্যন্ত রিজার্ভ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে কিন্তু চার মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আমদানি বেড়ে যদি ৬ বিলিয়ন হয়, তাহলে কিন্তু ৩ মাসের কিছু বেশি সময়ের খরচ মিটবে। তার মানে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।।”

“রিজার্ভ যেনো আর না কমে—সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমরা বার বার সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিলাম। গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেও অনুরোধ করেছিলাম।”

“কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। রিজার্ভ কমছেই। প্রকৃত রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলার নামা কিন্তু একটি স্পর্শকাতর মানদণ্ড।”

দুই বছরেই টাকার মান কমেছে ৩১ শতাংশ

মাঝে দেড় বছর ছাড়া (২০২১ সালের আগস্টের আগে দেড় বছর) প্রতি বছরই টাকার মান কমেছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করে থাকে ডলারে। অনেকটা ‘রক্ষণশীল নীতি’ অবলম্বন করায় আওয়ামী লীগ সরকারের ১২ বছরে (২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল) ডলারের বিপরীতে টাকার মাস কমেছিল ২৪ শতাংশের মতো। আর গত দুই বছরেই কমেছে ৩১ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের জন্য লাগত ৬৯ টাকা। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে প্রতি ডলারের মূল্যমান ছিল ৭৯ টাকা ৭৫ পয়সা।

বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দিত। ২০০৩ সালে এই বিনিময় হারকে করা হয় ফ্লোটিং বা ভাসমান। এর পর থেকে আর ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না।

তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরোপুরি তা বাজারভিত্তিক থাকেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই এতে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখে আসছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। 

পরে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর।

এর পর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন। 

তবে, এবিবি ও বাফেদার এই সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই মানেনি ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক এই দুই সংগঠনের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করেছে। এজন্য কয়েক দফায় কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক ও জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন, আমদানির ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ডলারের দামে বেশি রাখছে ব্যাংকগুলো।

 

৪ মাসে রেমিটেন্স কমেছে ৪.৩৬ শতাংশ

রিজার্ভের প্রধান উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে রেমিটেন্স বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো কমছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১৩৩ কোটি ৩৬ লাখ (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। একক মাসের হিসাবে এই রেমিটেন্স ছিল সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

পরের মাস রেমিটেন্স অবশ্য বেশ খানিকটা বেড়েছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের মতো এসেছে। কিন্তু চার মাসের হিসাবে অর্থাৎ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিটেন্স কমেছে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

রপ্তানি আয় কমায় নতুন উদ্বেগ

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ মাস আক্টোবরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৭৬ কোটি ২০ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম। আর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ আয় কম এসেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৬ মাস পর সবচেয়ে কম রপ্তানি আয় দেশে এসেছে অক্টোবর মাসে। ২০২১ সালের আগস্টে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩৮ কোটি ৩০ লাখ (৩.৩৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিলেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা।

এর পর অক্টোবর মাসের মত এতো কম আয় কোনো মাসেই আসেনি।

এই মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৫২৫ কোটি ১০ লাখ (৫.২৫ বিলিয়ন) ডলার। গত বছরের অক্টোবরে আয় হয়েছিল ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ (৪.৩৫ বিলিয়ন) ডলার।

অক্টোবর মাসে রপ্তানিতে ধস নামলেও অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। এই চার মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৭৪৪ কোটি ৭৫ লাখ (১৭.৪৪ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে । যা গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম এসেছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।

আমদানি কমায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে

ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপ নেয়। তার সুফলও মিলেছে। আমদানি ব্যয় বেশ কমে এসেছে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১ হাজার ৪৭৪ কোটি ৯০ লাখ (১৪.৭৫ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।

আহসান মনসুর বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সব দেশেই পড়েছে। সব দেশেই ডলারের দর বেড়েছে; মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। সামাল দিয়ে তারা কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব দেশেই মূল্যস্ফীতি কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে উঠে গিয়েছিল; এখন ১ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে তারা।

“কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি কমছে না। ডলার সংকট কাটছে না; ডলারের বাজারে অস্থিরতা যাচ্ছে না। রিজার্ভ কমছেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে আমরা কী করছি; সব দেশ পারলে আমরা পারছি না কেনো? আমাদের গলদ কোথায়? আমরা কী ঠিকঠাক মত ব্যবস্থাপনা করছি না।?”

“এখানে দুটি বিষয় আমি পরিস্কারভাবে উল্লেখ করতে চাই। দীর্ঘদিন ডলারের দর ধরে রেখে আমরা ঠিক কাজটি করিনি। ওইটা ছিল আমাদের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত। আরেকটি ভুল ছিল আমাদের—মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল; তারপরও আমরা ৯ শতাংশ সুদ হার দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলাম। এখন অবশ্য সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই দুই ভুলের মাশুলই আমাদের এখন দিতে হচ্ছে। আরও কতদিন দিতে হবে কে জানে?”

আহসান মনসুর বলেন, “তথ্যের পরিবর্তে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবকে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক। যদিও অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির চাপের উৎস আমদানি করা উৎসের মধ্যে নিহিত থাকে। তবে পর্যাপ্ত চাহিদা ব্যবস্থাপনা নীতি না থাকার কারণেও টিকে থাকে মূল্যস্ফীতি।

কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও থাইল্যান্ড, ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বলে তথ্য দেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা মনসুর। বলেন, “সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা কমানোর নীতি অবলম্বন করে এসব দেশ সফলভাবে মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে।”

“আমরা করিনি। তাই পারিনি। দেরিতে করছি। দেরিতেই ফল পাওয়া যাবে।”

তিনি বলেন, “ডলার সংকটের কারণে আমদানি লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সব কিছুর আমদানি কমছে। এতে শিল্প উৎপাদন কম হবে। কর্মসংস্থান হবে না। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হবে।”

“তবে আমি মনে করি, বর্তমান এই সংকটের সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা এবং ডলারের বাজারকে সুস্থির করার দিকেই সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।

সেইসঙ্গে রিজার্ভ যাতে আর না হবে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। যে করেই হোক রেমিটেন্স বাড়াতে হবে। হুন্ডি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”

“একটা বিষয় আমি পরিস্কার করে বলতে চাই। এই সংকটের সময় যদি ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অর্জিত হয় তাতেই আমি খুশি। এখন আমাদের যে অসুখ হয়েছে, সঠিক চিকিৎসা করে ঠিকমত ওষুধ দিয়ে আগে সুস্থ করতে হবে। তার পর জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে তাকাতে হবে।”

সেই শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন ১.২%, বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ পরবর্তী

সেই শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন ১.২%, বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ

কমেন্ট