অর্থনীতিতে নতুন সরকারের চার চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতিতে নতুন সরকারের চার চ্যালেঞ্জ

মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা, ডলারের বাজার সুস্থির করে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বৃদ্ধি, নড়বড়ে ব্যাংক খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ব্যবসায়ী নেতারা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পর শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার তার পঞ্চম সরকারের সদস্যদের নিয়ে শপথ নিয়েছেন।

লক্ষ্য এবার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’- আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল তাই। সেই লক্ষ্যের যাত্রায় নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন শেখ হাসিনা। দপ্তরও বণ্টন করে দিলেন তাদের। শপথের পরপরই নতুন ৩৬ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর বণ্টনের প্রজ্ঞাপন আসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে।

তাতে দেখা যায়, শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় রেখেছেন নিজের হাতে।

গতবারের অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী তিনজনকেই বাদ দিয়ে নতুন মুখ এনেছেন শেখ হাসিনা।

করোনা মহামারি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় গতিহারা অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করাই যখন আওয়ামী লীগের নতুন সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে, তখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব শেখ হাসিনা তুলে দিয়েছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলীর হাতে।

অর্থনীতির ছাত্র মাহমুদ আলী রাজনীতিতে আসার আগে ছিলেন পেশাদার কূটনীতিক। তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন।

এখন এমন এক সময়ে তাকে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাল ধরতে হচ্ছে যখন রেকর্ড মূল্যস্ফীতিতে জনজীবনে কষ্ট বেড়েছে, ডলারের দর আর রিজার্ভ সঙ্কট হয়ে উঠেছে সরকারের বড় মাথাব্যথা। আর্থিক ও ব্যংক খাতে সুশাসনের জন্য সংস্কারের আহ্বান অনেক বেশি জোরালো হয়ে উঠেছে।

এই কঠিন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার এবারের সরকারের সামনে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা, ডলারের বাজার সুস্থির করে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বৃদ্ধি, নড়বড়ে ব্যাংক খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ব্যবসায়ী নেতারা।

তারা বলেছেন, সময়টা খুবই কঠিন। দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও ওলোটপালট করে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই নিম্নমুখী। সংকট প্রায় সব ক্ষেত্রেই। আর এর জন্য বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি সরকারের ভুল নীতিও অনেকখানি দায়ী। তাই অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই এখন নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তারা।

বিদায়ী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে দেশের মানুষের মধ্যে। তার কর্মকাণ্ডে খুশি হন অনেকে। অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল অর্থমন্ত্রীকে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে তার অনুপস্থিতি সবার চোখে পড়েছে। শোনা যায়, অসুস্থতার কারণে তিনি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কখনই কিছু জানানো হয়নি।

ফলে অর্থনীতিতে মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত মোকাবেলায় আর্থিক খাতে নতুন নেতৃত্ব আসার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই নেতৃত্বে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আনা হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে। ৮০ বছর পেরিয়ে আসা মাহমুদ আলী কূটনীতিক হিসেবেই পরিচিত। ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসা মাহমুদ আলী ২০১৪ সালের সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তবে বিদায়ী সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। গতবার তাকে সরকারে না নিলেও এবার ফেরানো হয়েছে তাকে; দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

তার সামনে এখন চার চ্যালেঞ্জ—মূল্যস্ফীতি কমানো, রিজার্ভ বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা এবং রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। নতুন অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী কি পারবেন এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে—সেটাই এখন দেখার বিষয়।

নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রেখেছেন দেশের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেছেন, “অনেকটা চমক হিসেবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাহমুদ আলী অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতির ছাত্র মাহমুদ আলী রাজনীতিতে আসার আগে ছিলেন পেশাদার কূটনীতিক। তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন। আমার বিশ্বাস তিনি ভালো করবেন। সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, সেগুলো মোকাবেলা করতে পারবেন।”

এআরএইচ ডট নিউজকে ফরাসউদ্দিন বলেন, “সত্যি কথা বলতে কি, গত পাঁচ বছরে আমরা অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্ব অনুপস্থিত দেখেছি। যেটা সবার চোখে পড়েছে। হতে পারে অসুস্থতার কারণে তিনি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তাই এবার অনেক চিন্তাভাবনা করে প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ আলীকে দায়িত্ব দিয়েছেন।”

“নতুন অর্থমন্ত্রীকে একটি বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোটেই অনুকুলে নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ছোবল এখনও লাগছে আমাদের অর্থনীতিতে। সে কারণেই কিন্তু ডলারের সংকট। রিজার্ভ কমে গেছে।”

“তাই ইইরোপ-আমেরিকার বাজারে আমাদের পণ্য রপ্তানি যাতে কোনোভাবেই ক্ষতি না হয়-সে দিকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশ যায় কিন্তু এই দুই বাজারে। আরেকটি বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে; সেটি হচ্ছে রেমিটেন্স। মধ্যপাচ্যের দেশগুলো থেকে যে রেমিটেন্স আসে, সেটা যাতে আরও বাড়ে-সেটার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রয়োজনে প্রণোদনা আরও বাড়াতে হবে; আর সেই প্রণোদনা যেনো সরাসরি রেমিটেন্সভোগীরা পায়, মধ্যসত্বভোগীরা না পায়—সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”

অর্থনীতির আরেক সূচক মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর পাশপাশি সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবিকে শক্তিশালী করে এর কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করতে নতুন সরকারকে পরামর্শ দেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

“একটা কথা আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, যারা বেশি সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, তারা কিন্তু ঠিকই ঋণ শোধ করেন। কোনো দিনই খেলাপি হন না। আর যারা কম সুদে ঋণ নেন, তারা ঋণ শোধ করেন না। ইচ্ছে করে খেলাপি হন।”

“একইসঙ্গে টাকা পাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এ সব কিছুর নেতৃত্ব দিতে হবে কিন্তু অর্থমন্ত্রীকে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং খাতের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যাতে একটি টাকাও খেলাপি না হয়,” বলেন ফরাসউদ্দিন।

আরেক অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে নতুন সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসলেও আমরা কিন্তু পারিনি। তাই আমি মনে করি মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরাই নতুন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিৎ।

“দ্বিতীয়ত, আর্থিক খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে পরিস্কার দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো নয়—এটা স্বীকার করে নিয়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার পাশপাশি ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। এ জন্য ব্যাপক সংস্কার করতে হবে।”

“শেষে আমি রপ্তানি আয়, রেমিটেন্সসহ বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) বাড়ানোর মাধ্যমে রিজার্ভ বৃদ্ধি করতে নতুন অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো। রিজার্ভ বাড়লে কিন্তু ডলারের বাজারের অস্থিরতাও কেটে যাবে। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে।”

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “গত পনের বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। নতুন সরকারকে এটা ধরে রাখতে হবে। একইসঙ্গে দুর্নীতি কমাতে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। শিল্প খাতে গ্যাস-বিদ্যুতের যে সমস্যা আছে সেটা সমাধান করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমাদের অর্থনীতি কিন্তু চাপের মধ্যে আছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। এটা বাড়তে রপ্তানি আয় বাড়তে হবে। তাই বরাবরের মতোই রপ্তানি খাতের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।”

‘সংকট সামাল দিতে বিচক্ষণ অর্থমন্ত্রী চাই’ পরবর্তী

‘সংকট সামাল দিতে বিচক্ষণ অর্থমন্ত্রী চাই’

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর