এগিয়ে চলেছে নারী
এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘নারীর সম-অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে।
রূপালী চৌধুরী ২০০৮ সাল থেকে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তিন মেয়াদে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফআইসিসিআই) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। রূপালী চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে অনার্সসহ স্নাতক করেছেন।
আরেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা বাংলাদেশের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হয়েছেন বাংলাদেশি নারী জু-উন নাহার চৌধুরী। প্রথম বাংলাদেশি ও প্রথম নারী হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠানটির এমডির দায়িত্ব পেয়েছেন।
এভাবেই ব্যবসায়িক জগত থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা দ্রুতগতিতে তাদের অবস্থান দৃঢ় করছেন। উদ্যোক্তা, ব্যবস্থাপক ও নেতৃত্বে পৌঁছাচ্ছেন নারীরা, যা দেশের অর্থনীতিতে তাদের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকসহ আরও অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এখন শ্রমিক বা মধ্যম স্তরের নারী কর্মীরা তো কাজ করছেনই, সেই সঙ্গে পরিচালক ও মালিক হিসেবেও নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এটা এখন বাংলাদেশের বড় অর্জন।
আর এমন সব অর্জনের মধ্য দিয়েই শুক্রবার (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘নারীর সম-অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে।
দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের নারীসমাজ এগিয়ে যাবে। গৃহকর্মে নারীর শ্রম ও অবদানকে জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নারী-পুরুষ সমতা অর্জন ও নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিনিয়োগ এবং জেন্ডার-রেসপনসিভ অর্থায়নকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য এবং ২০৪১ সালের উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবদান রেখে চলেছে নারীরা। ব্যাংক, বিমা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবেও বাংলাদেশে নারী কাজ করছেন। এখন অনেক নারী শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও চালাচ্ছেন। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ বা পরিচালনা পর্ষদেও রয়েছেন অনেক নারী।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হুমায়রা আজম। তিনি ২০১৮ সাল থেকে ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। হুমায়রা আজম বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনও বাণিজ্যিক ব্যাংকে প্রথম নারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। অতীতে কয়েকজন নারী ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন হুমায়রা।
এছাড়া সিটি ব্যাংকের চার দশকের ইতিহাসে প্রথম নারী অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মাহিয়া জুনেদ। একই ব্যাংকের মানব সম্পদ বিভাগের (এআরআর) প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন নিশাত আনোয়ার।
ইন্সুরেন্সের শীর্ষ পদেও রয়েছেন একজন নারী। গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করছেন ফারজানা চৌধুরী।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সহজ ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন তথ্য প্রযুক্তি খাতের পরিচিত মুখ মালিহা এম কাদির। এ খাতের আরেক পরিচিত মুখ সোনিয়া বশির কবির মাইক্রোসফট বাংলাদেশের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে তিনি বর্তমানে এ দায়িত্ব পালন করছেন না।
দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নেতৃত্বেও আছেন নারী। সংগঠনটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শমী কায়সার। তিনি দেশের ই-কমার্স খাতের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি।
দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী গ্রুপ নিটল-নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান হলেন একজন নারী। তিনি হলেন সাবেক সংসদ সদস্য সেলিমা আহমাদ। বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তিনি। ২০১৪ সালে ব্যবসায় অনন্য অবদানের জন্য সেলিমা আহমাদ অসলো বিজনেস ফর পিস পুরস্কার লাভ করেন।
আরেক নারী ফাহমিদা খাতুন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো।
আরেক গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালকও নারী। তিনি হলেন সায়েমা হক বিদিশা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক।
আরেক নারী রুবাবা দৌলা ওরাকল বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটানের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। এছাড়া দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও তিনি।
দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক শিল্পগোষ্ঠী সামিট গ্রুপ। এই গ্রুপের যোগাযোগ, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ এবং শিপিংসহ আরও অনেক ব্যবসা রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া সিঙ্গাপুরসহ আরও কয়েকটি দেশে রয়েছে সামিট গ্রুপের ব্যবসা।
এই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হচ্ছেন আয়েশা আজিজ খান। তিনি সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের মেয়ে। ২০২৩ সালেও সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের আজিজ খান। তিনি সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান। মার্কিন সাময়িকী ‘ফোর্বস’গত বছরের সেপ্টেম্বরে সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেই তালিকায় আজিজ খানের অবস্থান ৪১তম। ২০২২ সালে তার অবস্থান ছিল ৪২ নম্বরে।
আজিজ খানের আরও দুই মেয়েও পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আদিবা আজিজ খান ও আজিজা আজিজ খান দুজনই সামিট গ্রুপের পরিচালক।
গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী বিজ্ঞাপনী সংস্থা অ্যাডকম লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। তিনি দেশের আধুনিক বিজ্ঞাপন শিল্প প্রসারে অগ্রণী ভুমিকা পালনকারীদের অন্যতম। ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে গড়ে তোলা গবেষণা সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন নিহাদ কবির। তিনি সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ল ফার্ম সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সিনিয়র পার্টনার। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট নিহাদ কবির। এছাড়া তিনি ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেড ও ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্বও পালন করছেন একজন নারী। তিনি বলেন ফেরদৌস আরা বেগম।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পরিচালনা পর্ষদেও তিন জন নারী পরিচালক রয়েছেন। তাদের একজন হলেন ব্যারিস্টার বিদ্যা অমৃত খান। তিনি বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা দেশ গার্মেন্টস-এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
আরেকজন হলেন—ব্যারিস্টার শেহরিন সালাম ঐশী। তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ পেঅমাক কারখানা এনভয় ডিজাইনের পরিচালক এবং বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদীর মেয়ে।
নীলা হোসনে আরাও বিজিএমইএ’র একজন পরিচালক। তিনি নারায়ণগঞ্জের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ক্রোনী গ্রুপের চেয়ারপারসন।
কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও আছেন কয়েক জন নারী। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছেন রুকমীলা জামান। তিনি বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগের মেয়াদেও তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
নারী উদ্যোক্তা রুকমীলা জামান আরামিট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের স্ত্রী।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আরও তিন জন নারী পরিচালক আছেন। তারা হলেন—রোকসানা জামান, আফরোজা জামান এবং মাসুমা পারভিন।
আরেক বেসরকারি ব্যাংক ইষ্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) পরিচালনা পর্ষদে আছেন তিন নারী। তারা হলেন—দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহা. নূর আলীর স্ত্রী সেলিনা আলী। তিনি ইউনিক গ্রুপের চেয়ারপারসন। এই ব্যাংকে অন্য দুই নারী পরিচালক হলেন—কিশোয়ার জাহান সাইদা এবং জারা নমরীন। এর মধ্যে জারা নমরীন জেএফ (বাংলাদেশ) লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক।
দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনার কেন্দ্রে থাকায় ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গত ২১ ডিসেম্বর ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেইসঙ্গে নতুন করে ৭ পরিচালক দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যাংকটি জয়নুল হক সিকদারের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে জয়নুল হক সিকদারের দুই ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার বোর্ড থেকে বাদ পড়লেও নতুন বোর্ডে রয়েছেন তার মেয়ে পারভিন হক শিকদার।
সিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আছেন তিন জন নারী। তারা হলেন—সৈয়দা শায়ারীন আজিজ, সাভেরা এইচ মাহমুদ এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) মনোনিত পরিচালক রেবেকা ব্রসনান।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) পরিচালনা পর্ষদে দুই নারী আছেন। একজন জেবুন্নেসা আকবর। আরেকজন বদরুন্নেসা আলম।
উত্তরা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নারী পরিচালক আছেন একজন। তিনি হলেন বদরুন্নেসা শারমিন ইসলাম।
এছাড়া আরও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নারীরা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
কমেন্ট