প্রথাগত পেনশনের চেয়ে প্রত্যয়ে কী লাভ
সরকারের নতুন চালু করা পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ সরাসরি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তারা যে ধরনের পেনশন সুবিধা পাচ্ছেন, তেমনই পাবেন।
দেশে বিদ্যমান যে পেনশন কর্মসূচি (স্কিম) যেসব প্রতিষ্ঠানে চালু আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা চাকরি শেষে অবসর সুবিধা হিসেবে এককালীন অর্থ পান, কিন্তু মাসিক হারে তা পান না। ফলে অবসরোত্তর জীবনে প্রায় ক্ষেত্রেই সুবিধাভোগীরা আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন। এই যুক্তি তুলে কর্মীদের অবসরোত্তর জীবনের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রবর্তন করেছে সরকার।
তবে এই প্রত্যয় স্কিমে বিদ্যমান ব্যবস্থার মতো অবসরের পর এককালীন অর্থ পাওয়া যাবে না এবং সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হবেন- এমন অভিযোগ উঠেছে।
সরকারি সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে এই প্রত্যয় স্কিম চালু করা হয়েছে। এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় বুধবার (২০ মার্চ) দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং এদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে আগামী ১ জুলাই থেকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকার পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করল।
একই দিন সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে আরেক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর ১ জুলাইয়ের পর থেকে ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচি বাধ্যতামূলক। ২০২৩ সালের ১৭ আগস্টে চালু হওয়া ‘প্রগতি’, ‘প্রবাস’, ‘সুরক্ষা’ ও ‘সমতা’ —এই চার সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি ঐচ্ছিক হলেও নতুন স্কিম বাধ্যতামূলক।
তবে সরকারের এ-সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছে, এ-সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে প্রয়োজনে তারা আন্দোলনে যাবেন।
আর বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত কয়েকটি ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেছেন, সরকার অনেক চিন্তাভাবনা করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজস্ব সুযোগ-সুবিধার অধীনে পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। ভালো কর্মকাণ্ডের জন্য আলাদা সুবিধাও পেয়ে থাকেন। তাই সরকারের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি ‘প্রত্যয়’ স্কিম নিয়ে তাদের কোনও ম্যাথাব্যাথা নেই।
একই কথা বলেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, “সরকার দেশের সব মানুষকে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতায় আনতে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় নতুন যোগ দেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘প্রত্যয়’ স্ক্রিম বাধ্যতামূলক করেছে।
“এতে তাদের সুবিধা হবে বলেই মনে হচ্ছে। কেননা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তারাও নিজস্ব সুযোগ-সুবিধার অধীনে পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর বাইরে ‘প্রত্যয়’ স্কিমের সুবিধা পেলে তাদের জন্য ভালোই হবে।”
এ ব্যাপারে গত ১৮ মার্চ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, সব নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতেই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যেই কাজ করছে সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় ‘প্রত্যয়’ স্ক্রিম চালু করা হয়েছে। এতে সবাই লাভবান হবেন। সার্বিকভাবে বৃহত্তর স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যারা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন, তারা তাদের বিরোধিতা থেকে সরে আসবেন বলে আশা করছি।
স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থাগুলোতে বর্তমানে ১৪ লাখের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। আর সরাসরি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৬ লাখের মতো।
সরকারের নতুন চালু করা পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ সরাসরি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তারা যে ধরনের পেনশন সুবিধা পাচ্ছেন, তেমনই পাবেন।
যাদের জন্য ‘প্রত্যয়’
সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তা প্রায় ৪০০ সংস্থার ওপর কার্যকর হবে। যেসব সংস্থা ৫০ শতাংশের বেশি সরকারি অর্থায়নে চলে, সেগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। আর স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বোঝানো হয়েছে সেগুলোকে, যারা কোনও আইনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা। এর মধ্যে কোনও কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, কমিশন, সংস্থা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমি, ট্রাস্ট, বোর্ড, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি রয়েছে।
এর বাইরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), জীবন বীমা করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ইত্যাদি রয়েছে এ তালিকায়।
বিদ্যমান কর্মসূচি ও ‘প্রত্যয়’
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বর্তমানে সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলে (সিপিএফ) টাকা জমা রাখেন, যার বিনিময়ে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দেয়। এ টাকা পেনশনে যাওয়ার পর অবসরভোগীরা পেয়ে থাকেন। যেসব সরকারি কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন জিপিএফে। আর যারা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন সিপিএফে। অল্প সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা চাকরি শেষে বিদ্যমান কর্মসূচির আওতায় অবসর সুবিধা হিসেবে এককালীন অর্থ পেলেও মাসিক হারে তা পান না।
‘প্রত্যয়’ স্কিমে চাঁদার বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, মূল বেতনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা– এ দুয়ের মধ্যে যেটি কম, সংশ্লিষ্ট সংস্থা তা চাকরিজীবীর বেতন থেকে কেটে রাখবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংস্থা দেবে। দুই অঙ্ক একত্রে চাকরিজীবীর পেনশন আইডির (পরিচয় নম্বর) বিপরীতে সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমা করবে। যেদিন প্রতি মাসের বেতন দেওয়া হয়, তার পরের কর্মদিবসের মধ্যেই কাজটি করতে হবে। এ জমা অর্থের পরিমাণ ও মেয়াদের ভিত্তিতে অবসরকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী মাসিক পেনশন ভোগ করবেন।
‘প্রত্যয়’ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা
‘প্রত্যয়’ স্কিম নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বুধবার একটি ব্যাখা দিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় আগামী জুলাই থেকে যোগ দেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন আইনের আওতায় স্কিমটি আকর্ষণীয় এবং আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী জুলাইয়ের পর স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার চাকরিতে যারা যোগদান করবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় ‘প্রত্যয়’ স্কিমে যুক্ত করা হবে।
গত ১৩ মার্চ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, প্রত্যয় স্কিম চালু হলেও বিদ্যমান কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে না বরং তাদের বিদ্যমান পেনশন বা আনুতোষিক সুবিধা অক্ষুণ্ন থাকবে। তবে যাদের ন্যূনতম ১০ বছর চাকরি অবশিষ্ট আছে, তারা চাইলে প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় খুব কম সংখ্যক স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পেনশন স্কিম আছে। এ ধরনের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা আনুতোষিক স্কিমের আওতাভুক্ত এবং তাদের জন্য সিপিএফ ব্যবস্থা প্রযোজ্য। এ ব্যবস্থায় কর্মচারীরা চাকরি শেষে অবসর সুবিধা হিসেবে এককালীন আনুতোষিক পান। কিন্তু মাসিক পেনশন পান না। ফলে অবসরোত্তর জীবনে প্রায় ক্ষেত্রেই আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কর্মচারীদের অবসরোত্তর জীবনের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে সরকার ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রবর্তন করেছে। প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা প্রাপ্ত মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকার মধ্যে যা কম, সেই অঙ্ক তাদের বেতন থেকে কাটা হবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। এর পর উভয় অর্থ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কর্মকর্তা বা কর্মচারীর পেনশন আইডির বিপরীতে জমা করবে। এ প্রক্রিয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেনশন ফান্ড গঠিত হবে এবং সেই ফান্ড থেকে পেনশন দেওয়া হবে।
এতে বলা হয়, বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থায় কর্মচারী মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ দেয়। তবে প্রত্যয় স্কিমে প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ১০ শতাংশ দেবে; সিপিএফ ব্যবস্থা থেকে যা ১ দশমিক ৬৭ বেশি।
প্রত্যয় স্কিমে একজন ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর নিজ বেতন থেকে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং প্রতিষ্ঠান একই পরিমাণ টাকা ৩০ বছর চাঁদা দিলে অবসরের পর অর্থাৎ ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা হারে পেনশন পাবেন।
৩০ বছর ধরে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিলে কর্মী নিজ বেতন থেকে দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়াবে ৯ লাখ টাকা এবং সংস্থা জমা করবে আরও ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর সর্বমোট চাঁদার পরিমাণ হবে ১৮ লাখ টাকা। তিনি যদি ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, তবে ১৫ বছরে পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা নিজ জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, পেনশনের সুবিধা আজীবন মিলবে বলে এ অঙ্ক আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য মুনাফার হার বাড়লে মাসিক পেনশনের পরিমাণ আরও বাড়বে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের যাবতীয় খরচ সরকার নির্বাহ করবে বলে চাঁদাদাতার আইডিতে জমাকৃত অর্থ এবং বিনিয়োগ থেকে আয় সম্পূর্ণ চাঁদাদাতার অ্যানুইটি হিসাবায়নের মাধ্যমে মাসিক পেনশন নির্ধারণ করা হবে।
জমা করা চাঁদার ওপর বিনিয়োগ রেয়াত পাওয়া যাবে এবং প্রাপ্য পেনশন আয়করমুক্ত হবে। স্কিমটি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত হওয়ায় এটি শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ।
প্রত্যয় স্কিমে নিবন্ধিত কর্মী পেনশনযোগ্য বয়সে উপনীত হওয়ার পরবর্তী মাস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ব্যাংক হিসাবে মাসিক পেনশনের অর্থ পাবেন। মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে তাদের এ বিষয়ে অবহিত করা হবে। এ ক্ষেত্রে তাকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনও দপ্তরে যাওয়ার বা কোনও ধরনের প্রমাণ দেখানোর প্রয়োজন হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ
নতুন এ সিদ্ধান্তে স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কিছু না বললেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হয়েছেন সরব। অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার এসআরওর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
তারা বলছেন, এ প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হবেন। একই বেতন স্কেলের আওতাধীন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য সরকারের ভিন্ন নীতি সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তারা প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য আন্দোলনে যাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো এরই মধ্যে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিবৃতিতে দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের পর গত শুক্রবার (১৬ মার্চ) বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন জরুরি সভায় বসে। সেখানে তারা মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের বিশ্লেষণ করে। পরদিন শনিবার এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয়।
কেন আপনারা সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন– এ প্রশ্নে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আখতারুল ইসলাম বলেন, “বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের সম্মান করতেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে গেছেন। সেই শিক্ষকদের প্রদেয় সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে আর তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, এটিই আমাদের জন্য লজ্জার।
“৩০ জুনের পর আমাদের যে নতুন সহকর্মীরা আসবেন তারা জানবেন তারা কোনও সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আর আসবে কি?”
ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, “আমরা আমাদের জন্য কিছু করছি না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য, মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় ধরে রাখার জন্য কাজ করছি।
“যে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। মেধাবীরা এ পেশায় আসবে না।”
কেন সরকারের এই সিদ্ধান্ত
‘সুখে ভরবে আগামী দিন, পেনশন এখন সর্বজনীন’-এই স্লোগান নিয়ে ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিম কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতেই আলোচিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়।
শুরুতে যেসব স্কিম চালু করা হয়েছিল সেগুলো হলো- ‘প্রবাস’, ‘প্রগতি’, ‘সুরক্ষা’ ও ‘সমতা’।
সে সময় অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছিল সুবিধামতো সময়ে সরকার আরও দুটি স্কিম চালু করে স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ কর্মসূচির আওতায় আনবে। সেই ধারাবাহিকতায় ‘প্রত্যয়’ স্কিম চালু করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, “কোনও বিষয়ে সংস্কার আনা মানেই কিছু অংশ লাভবান হবেন, আবার কেউ কেউ কিছুটা হলেও ক্ষতির মুখে পড়বেন। তবে সরকার এসব ক্ষেত্রে বেশি সংখ্যক যেন লাভবান হয়, সেদিকে নজর দিয়ে থাকে।
“নতুন এ ব্যবস্থায় অল্প কিছু সংখ্যকের সুবিধা হয়তো কমবে, কিন্তু এর বিপরীতে বড় একটি অংশ বাড়তি লাভবান হবেন। তাছাড়া নতুন বিধান বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এমনকি আগামী জুলাইয়ের আগে কেউ যোগ দিলে, তারাও এখনকার নিয়মে পেনশন পাবেন।”
অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন সিদ্ধান্ত আসার আগে এ-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান পেনশন সুবিধা পর্যালোচনা করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন কমিশন ও করপোরেশনে সরকারি কর্মচারীদের আদলেই পেনশন দেওয়া হয়, যা এ ধরনের মোট প্রতিষ্ঠানের ২৫ শতাংশের বেশি নয়। এর বাইরে প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে সিপিএফের মাধ্যমে অবসর সুবিধা দেওয়া হয়। এ তহবিলে চাকরিজীবীরা তাদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমা দেন, আর সংস্থা দেয় ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অবসরের পর এ টাকা এবং এর বাইরে প্রতিবছর দুই মাসের মূল বেতনের সমান আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি) পান তারা। আবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রদেয় ভবিষ্যৎ তহবিলও নেই। এ ক্ষেত্রে অবসরের পর চাকরিজীবীরা শুধু গ্র্যাচুইটি পেয়ে থাকে। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, সবাইকে একই সঙ্গে এ কর্মসূচির আওতায় আনার সক্ষমতা সরকার কিংবা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নেই। এখন স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থাকে এর আওতায় আনা হলো। কিছুদিন পর হয়তো নন-গেজেট সরকারি চাকরিজীবী, পরে পর্যায়ক্রমে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আনা হবে।
সংস্থাগুলোতে নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন সুবিধা কমবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, “এটা আপেক্ষিক। তবে অনেক দিন চর্চা ও বিশ্লেষণের পরই আমরা এমন সিদ্ধান্তে এসেছি।”
কমেন্ট