পেনশন স্কিমে মূল্যস্ফীতির প্রভাব

পেনশন স্কিমে মূল্যস্ফীতির প্রভাব

সঞ্চয়ের প্রতীকী ছবি

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে সরকার যে সাড়া আশা করেছিল, আট মাস গড়ালেও সেই আশা পূরণ হয়নি।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি প্রভাব ফেলছে এই ক্ষেত্রে। তেমন কোনও পরিসংখ্যান হাতে না থাকলেও মূল্যস্ফীতির হার তার এই কথাকে অনেকটাই ভিত্তি দিচ্ছে।

গত বছরের মার্চে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশের উপরে যে ওঠে, তারপর আর কোনও মাসেই নামেনি। ১৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। সবশেষ মার্চ মাসে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক এই সূচক ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে উঠেছে।

এরমধ্যেই গত বছরের অগাস্টে ‘সুখে ভরবে আগামী দিন, পেনশন এখন সর্বজনীন’ স্লোগানে এই পেনশন স্কিম চালু করে সরকার।

বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনা এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই পেনশন স্কিম চালু করা হয়।

শুরুতে পেনশন স্কিম নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি ছিল না৷ কিন্তু দিন যত যেতে থাকে, মানুষের অংশগ্রহণের হার কমতে থাকে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে এই পেনশন পরিকল্পনা রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়ও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, জনগণের কাছ থেকে টাকা তুলে সরকার নির্বাচনী খরচ মেটাবে।

তার বিপরীতে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য না থাকাও মানুষের মধ্যে পেনশন স্কিম নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি করেছে বলে অনেকের ধারণা।

স্কিমগুলোর কী হাল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সেদিন থেকেই তা সবার জন্য উন্মুক্ত।

প্রথম দিন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে ৮ হাজার মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করলেও পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে চাঁদা দিয়েছিলেন ১ হাজার ৭০০ জন।

শুরুতে চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য চার ধরনের পেনশন স্কিম চালু হয়। সেগুলো হচ্ছে- প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাস।

বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাস’এবং দেশের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’।

চার স্কিমে প্রথম মাসে প্রায় ১৩ হাজার জন অন্তর্ভুক্ত হলেও দ্বিতীয় মাসে যোগ হয় ১ হাজার ৬৬৯ জন। তৃতীয় মাসে অন্তর্ভুক্ত হয় ১ হাজার ১৩৪ জন, চতুর্থ মাসে ১ হাজার ৩১২ জন।

প্রথম চার মাসে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৭ হাজার ১৬৬ জন। মোট টাকা জমা পড়েছিল ২১ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, সব মিলিয়ে আট মাসে এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ৫৪ হাজার জন। ৪৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা জমা হয়েছে।

এর মধ্যে প্রবাস স্কিমের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। এই স্কিমে প্রথম এক মাসে ৩৯৮ জন প্রবাসী অন্তর্ভুক্ত হয়ে চাঁদা পরিশোধ করে। কিন্তু এ হার পরে বজায় থাকেনি। আট মাস পর সর্বমোট অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৯৮ জন।

সরকারের আশা ছিল, বিপুল পরিমাণ প্রবাসী এই পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত হয়ে বৈধ চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাবে। কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি এখনও।

এই আট মাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ যুক্ত হয়েছে সমতা স্কিমে, ২৬ হাজার ৫৮০ জন। প্রগতিতে ১১ হাজার ১০৫ জন এবং সুরক্ষায় ১৬ হাজার ৩৭৬ জন যুক্ত হয়েছে।

স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার নতুন কর্মচারী যারা এ বছরের ১ জুলাইয়ের পর যোগ দেবেন তাদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তারা সবাই ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

মূল্যস্ফীতির কী প্রভাব

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, এই পেনশন স্কিম চালু হয়েছে কিছুটা অসময়ে।

তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এটা এমন একটা সময়ে চালু করা হয়েছে, যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শুধু স্বল্প আয়ের নয়, মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতারও অবনমন হয়েছে।

“এখানে তাদের এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে সংকোচ রয়ে গেছে৷ উদ্যোগটা ভালো, কিন্তু যেই সময়ে এটা চালু করা হয়েছে, সেটা খুবু উপযুক্ত না৷ অর্থনীতি স্থিতিশীল হলে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসলে তখন মানুষ হয়ত উৎসাহী হবে।”

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। কিন্তু পারেনি। লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ পয়েন্ট বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছে। অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো এই লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব বলে মনে করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত সপ্তাহে মূল্যস্ফীতি নিয়ে যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতেও ইতিবাচক তথ্য নেই।

সবশেষ গত মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্য বলছে, মার্চে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় খাতেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।

আহসান মনসুর বলেন, “সুরক্ষা স্কিমটিতে সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা শুরু থেকেই ছিল না; যদিও সেখানে চাঁদাদাতার ৫০০ টাকার সাথে সমপরিমাণ টাকা সরকার দেবে বলে জানিয়েছে।

কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় প্রতি মাসে সেই অর্থটুকু দেওয়াও দরিদ্রদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ সেই উদ্বৃত্ত অর্থটুকুও তাদের কাছে নেই৷ একই পরিস্থিতি বলা চলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদেরও।”

মূল্যস্ফীতি ছাড়াও পেনশন স্কিম নিয়ে মানুষের মনে সংশয় এখনও কাটেনি বলেই মনে করেন আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, “এ কর্মসূচি নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে দেওয়া হয় না। সার্বিকভাবে পরিষ্কর ধারণা জনগণকে দেওয়া না হলে এ উদ্যোগ সফলতা পাবে না।

“সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকার আইনের বলে কর্মচারীদের এই স্কিমে আওতায় নিয়ে আসতে পারবে৷ কিন্তু তারা আর কতজন?”

আশাবাদী কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে নানা উদ্যোগ

প্রথম আট মাস পর্যন্ত মানুষের সাড়া তেমন না মিললেও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এই চিত্র বদলে যাবে।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “যেভাবে মানুষ অংশ নিচ্ছে, খুব শিগগিরই ওই সংখ্যা লাখে চলে যাবে। মাঝখানে কিছুদিন ধীরগতি ছিল, এখন মানুষের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ বেড়েছে। আশা করছি, এই গতি অব্যাহত থাকবে।”

দেশ ও দেশের বাইরে সর্বজনীন পেনশন স্কিম আরও জনপ্রিয় করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

পেনশন স্কিমের আওতা বাড়াতে সম্প্রতি বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার নতুন কর্মচারীদে জন্য খোলা হয়েছে প্রত্যয় স্কিম।

আট বিভাগে ও ৬৪ জেলায় সর্বজনীন পেনশন মেলার আয়োজনও করা হচ্ছে। প্রথম মেলা হবে রাজশাহীতে। শুক্রবার রাজশাহী নগরীর হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ওই মেলার আয়োজন করা হয়েছে।

মেলায় মোট ৭০টির মতো বুথ থাকবে। মেলার স্টলগুলোতে সর্বসাধারণের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে সরাসরি নিবন্ধন ও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অর্থ জমা দেওয়ার সুযোগ থাকবে। আর্থিক লেনদেনের জন্য সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী, সিটি ও ব্র্যাক ব্যাংকের বুথ থাকছে।

মোস্তফা বলেন, “শুরুতে সোনালী ব্যাংক থাকলেও এখন অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসরকারি সিটি, ব্র্যাকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকও পেনশন স্কিমের সেবা দেওয়ার কাজ করছে। ফলে স্কিম নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী।”

পেনশন স্কিমের ব্যবস্থাপনা এবং বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় আছে সাধারণ মানুষের৷

অতিরিক্ত সচিব মোস্তফা বলছেন, “কর্মসূচিটির গ্যারান্টার যেহেতু রাষ্ট্র, তাই জনগণের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় বা ঝুঁকির কোনই কারণ নেই৷

“সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের ১৬ ধারায় সর্বজনীন পেনশন তহবিলের উল্লেখ রয়েছে৷ আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, এই তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং এর সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য একটি বিধিমালা থাকবে৷ আমরা এরই মধ্যে এ বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত করেছি৷ আশা করছি শিগগিরিই এই বিধিমালা পাস ও কার্যকর হবে।”

বিনিয়োগ কমিটির মাধ্যমে এই তহবিলের বিনিয়োগ হবে বলে এই অর্থ সরকার সরাসরি ব্যবহার করতে পারবে না বলেও জানান তিনি।

মোস্তফা জানান, এখন পর্যন্ত জমাকৃত টাকা তারা ‘সবচেয়ে নিরাপদ ও লাভজনক’ দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ সরকারি ট্রেজারি বন্ডে’ বিনিয়োগ করেছেন৷

প্রথাগত পেনশনের চেয়ে প্রত্যয়ে কী লাভ পরবর্তী

প্রথাগত পেনশনের চেয়ে প্রত্যয়ে কী লাভ

কমেন্ট