সিদ্ধান্তে তালগোল, খেসারত দিচ্ছে অর্থনীতি
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ব্যাংকিং খাতে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও পাহাড়সম খেলাপি ঋণের ভারে ডুবতে বসেছে অনেক ব্যাংক। সেই ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত বা মার্জার করতে গিয়ে হযবরল অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থনীতিতে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে সরকার। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে নতুন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তাতে সংকট আরও বাড়ছে। দিন যতো যাচ্ছে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো নেতিবাচক দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু পদক্ষেপ, কিছুদিন না যেতেই সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আলোচিত ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ঋণের জন্য একটার পর একটা শর্ত পূরণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার। জ্বালানি তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিসহ অনেক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এতে চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির পারদ আরও চড়ছে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমতে কমতে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। কমছে রপ্তানি আয়। বিনিয়োগে মন্দা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। পুঁজিবাজারে মন্দা কাটছে না।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ব্যাংকিং খাতে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও পাহাড়সম খেলাপি ঋণের ভারে ডুবতে বসেছে অনেক ব্যাংক। সেই ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত বা মার্জার করতে গিয়ে হযবরল অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সব মিলিয়ে দিন যতো যাচ্ছে অর্থনীতিতে সংকট ততোই বাড়ছে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—একটি ব্যবসায়ী ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে চলে গেছে ৬/৭টি ব্যাংক। চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলছে ইসলামী ব্যাংক, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক। বাংলাদেশে একটি গ্রুপের হাতে কয়েকটি ব্যাংক চলে যাওয়ার ঘটনা আগে কখনই দেখা যায়নি। এই ব্যাংকগুলোর কোনোটির অবস্থাই ভালো নয়।
সুনির্দিষ্ট করে বললে এভাবে বলা যায়, ৫/৬টি ছাড়া বাকি সব বেসরকারি ব্যাংকের স্বাস্থ্যই খরাপ। বেসরকারি ব্যাংকগুলো চলছে এখন উদ্যোক্তা পরিচালকদের কথায়। তাদের কথামতো না চললে যখন-তখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর হাজারো সমস্যা তো সেই জন্ম থেকেই।
এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে নতুন সংকট। দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই আরও দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। ওলোটপালট করে দিয়েছে সব হিসাব-নিকাশ। এরই মধ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মধ্যে ইরান জড়িয়ে পড়ায় সংকট আরও বাড়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সংকটের মধ্যে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে—এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বে প্রকাশ করেছেন এবং সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে বলেছে। ৮ মে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির যে আভাস দেখা যাচ্ছে, তা সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা যায়। দেশের অর্থনীতিতে এ সংঘাতের কিছুটা প্রভাব আসতে পারে।”
তিনি বলেন, “বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীলতা, বাজার ব্যবস্থাপনায় অসামঞ্জস্যতা এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সূত্রে দেশের মূল্যস্ফীতি কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে পণ্য সরবরাহের ‘সাপ্লাই-চেইন’ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মূলত ইরান বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রপ্তানিসংশ্লিষ্ট পরিবহন খরচ বেড়ে যেতে পারে। এতে পণ্য তৈরি ও সরবরাহের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানিকারকেরা কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে পারেন।
এমন অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখা এবং নিজ নিজ করণীয় নির্ধারণের জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন সরকার প্রধান।
আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, সরকার এখনই সবচেয়ে গভীর সংকটে রয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীনদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তায়।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, দুই বছরের করোনা মহামারির বেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছিল বাংলাদেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কাও কাটিয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু জানুয়ারিতে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সবকিছু যেনো কেমন হয়ে গেছে। অর্থনীতির কোনো কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে না। সরকার উন্নয়নের গল্পর ফলাও করে প্রচার করতে যতোটা ব্যস্ত, বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে ততোটাই উদাসীন বলে মনে করছেন তারা।
১৫ বছর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন টানা চার মেয়াদের মধ্যে প্রথমবার ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখনও বিশ্ব ছিল অর্থনৈতিক মন্দায়। এর সুফল পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর আগের দুই বছর সেনা-নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার খাদ্যের দাম নিয়ে মহাসংকটে ছিল। কিন্তু যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তত দিনে পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার সুফল পেয়েছিল বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশগুলো। এতে খাদ্যের দাম কমে যায়। হ্রাস পায় মূল্যস্ফীতির চাপ। ফলে নতুন সরকারের সামনে বড় কোনো সংকট ছিল না; বরং দায়িত্ব নিয়েই ডিজেল ও সারের দাম বেশ খানিকটা কমানো হয়। এতে লাভবান হন বোরো ধানের কৃষকেরা।
২০১৪ সালটা অবশ্য অতটা মসৃণ ছিল না। বিশেষ করে টানা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতে অর্থনীতির ক্ষতি ছিল ব্যাপক। ফলে বিনিয়োগ নিয়ে আশঙ্কাই ছিল বেশি। তবে সহিংসতায় ক্ষতি হয়েছে—এই সুযোগ নিয়েই শুরু হয়েছিল খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার মহোৎসব। এরই মধ্যে অর্থনীতি দেখে ফেলেছে বড় বড় অনেক ঋণ কেলেঙ্কারি। হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক ও পুঁজিবাজারে কেলেঙ্কারি ঘটে প্রথম মেয়াদেই। পরের পাঁচ বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই, একই সঙ্গে দুর্বল হয়েছে আর্থিক খাত।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর যখন টানা তৃতীয়বার দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগ, তখনো উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল। কিন্তু ব্যাংক খাতের অবস্থা হয়ে পড়ে আরও নাজুক—আর্থিক কেলেঙ্কারিও বেড়ে যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে, খেলাপি ঋণ ছাড়িয়ে যায় এক লাখ কোটি টাকা।
এখন সংকট সর্বব্যাপী। যে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে তুলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিল সরকার; এত অর্থ নিয়ে কী করবে, সেটাই ছিল ভাবনা, এখন সেই রিজার্ভ নিয়েই দুর্ভাবনা কাটছে না। ডলার সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে নানা শর্তের বেড়াজালে জড়িয়েছে সরকার। এমন অবস্থায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় জনঅসন্তোষের বাড়ানোর মতো ঝুঁকিও নিতে হচ্ছে।
এখন অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই নিম্নমুখী। সংকট সব ক্ষেত্রেই। অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুরের ভাষায়—বেশ কঠিন সময় পার করছে আমাদের অর্থনীতি। একেবারে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু পদক্ষেপ পরিস্থিতি সামাল না দিয়ে আরও বিপদ ঢেকে এনেছে। দুইটা বছর একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে, সেটা দুই বছর আগে নেওয়া হলে সংকট এতটা হতো না। মূল্যস্ফীতি সহনীয় থাকত; ডলারের বাজার অস্থির হত না। রিজার্ভ এত নিচে নেমে আসত না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “গত ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটি হচ্ছে—টাকা-ডলারের যে বিনিময় হার পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’চালু করেছে। এখন থেকে দেশের মধ্যে ডলারের দর লাফ দিতে পারবে না, কেবল হামাগুড়ি দিতে পারবে। আর সেই হামাগুড়ি দিতে হবে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে। সীমার বাইরে যাওয়া যাবে না। আরেকটি হচ্ছে—ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো নিজেরাই এখন বাজারের চাহিদা অনুযায়ী, সুদের হার ঠিক করবে।”
“আমি মনে করি এই দুটি সিদ্ধান্ত দুই বছর আগেই নেওয়া দরকার ছিল। আমরা বার বার বলেছিলামও। যাইহোক শেষ পর্যন্ত যে বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝতে পেরেছে সেটা মন্দের ভালো। এখন আর ভূল করা যাবে না। ভেবেচিন্তে সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অঅর এ সবের প্রতিফলন হতে হবে নতুন বাজেটে। বাজেটটা অবশ্যই ছোট হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর সেটা বাজেটের মাধ্যমে করতে হবে।”
“তবে ব্যাংকিং খাতে বড় ধাক্কা দিতে হবে। এবার এই খাতকে শৃংখলার মধ্যে আনতেই হবে; সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। দুর্বল ব্যাংক মার্জার কিন্তু সফল হবে না। বিকল্প কিছু ভাবতে হবে,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
“আমাদের সবার মনে রাখতে হবে,বাংলাদেশ যে উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করতে পেরেছিল, তার প্রধান কারণ সামষ্টিক অর্থনীতি ছিল স্থিতিশীল। অথচ সেটাই এখন হুমকির মধ্যে।”
সূচকে শঙ্কার বার্তা
এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদেই বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি গিয়েছিল। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ছিল উচ্চ প্রবৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতি বেশির ভাগ সময় ৫ শতাংশের আশপাশে ছিল।
কিন্তু এসব সূচক এখন অতীত। দেশের সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন মূল্যস্ফীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।
মূল্যস্ফীতি
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এই সময়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ হলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ।
এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ পাওয়া গেছে।
বিবিএসের ১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ওই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ।
রিজার্ভ
আইএমএফের কথামতো গত বছরের জুলাই থেকে বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগ পর্যন্ত শুধু ‘গ্রস’ রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হতো।
গত সোমবার আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ এখন ২৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানের ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে রিজার্ভ এখন টানটান অবস্থায় আছে।
প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ ধরলে তা হবে ১৪ বিলিয়ন ডলারের কম দেখা যাচ্ছে।
১৫ বছর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় বসেছিল, তখন ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। এরপর তা বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।
রপ্তানি
বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি উৎস রপ্তানি থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এসেছিল ১৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় হয় ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১০ মাসে অর্থাৎ জুলাই-এপ্রিল সময়ে এসেছে ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে গত বছর যেখানে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল, সেখানে গত ১০ মাসে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
রেমিটেন্স
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় খাত প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স। এই সূচকটি এখনও ভালো অবস্থায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার সময় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। তা বাড়তে বাড়তে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১০ মাসে রেমিটেন্স এসেছে ১৯ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। তাতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি
আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জনের খাত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে বরাবরই দেখিয়ে আসছে।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা সর্বপ্রথম ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তার পরের বছর কোভিড মহামারির ধাক্কায় তা ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আবার বেড়ে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছিল। পরের বছর ৭ শতাংশ ছাড়ালেও গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবার ৫ দশমিক ৭৮ শতাংেশ নেমে আসে।
চলতি অর্থবছরের দু্ই প্রান্তিকের জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাতে দেখা যায়, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রায় অর্ধেক। প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ শতাংশের বেশি।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরলেও তা যে অর্জিত হবে না, তা অর্থনীতিবিদরা তখনই বলছিলেন।
সুদের হার
২০০৮-০৯ অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ছিল বাজারভিত্তিক। অর্থাৎ বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে তখন সুদের হার নির্ধারণ করত ব্যাংকগুলো। সে সময় সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিত ব্যাংকগুলো।
ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে আলোচিত নয়-ছয় সুদ হার চালু করা হয়। অর্থাৎ ব্যাংকে আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে গত বছরের জুলাই থেকে নয়-ছয় সুদ হার তুলে দিয়ে ‘স্মার্ট’ সুদহার চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে সবশেষ সুদের হার গিয়ে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে ওঠে।
আইএমএফের পরামর্শে গত ৮ মে স্মার্ট সুদহার বাতিল করে ফের বাজারভিত্তিক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ এখন সেই ২০০৮-০৯ অর্থবছরের মতোই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করবে ব্যাংকগুলো।
এতে নিশ্চিত করে বলা যায়, ব্যাংক ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে। তাতে বিনিয়োগ কমে তা কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে উদ্যোক্তারা শঙ্কা প্রকাশ করে আসছে।
ডলারের দাম আরও বেড়েছে
ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু হয়েছে গত ৯ মে থেকে। এই পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের মধ্যবর্তী একটি দাম নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে এই দরের আশপাশে স্বাধীনভাবে লেনদেন করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মধ্যবর্তী এই দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা।
দুই বছর ধরে দেশে ডলারের সংকট চলছে। এ সময়ে ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। এর ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে দীর্ঘদিন ধরে ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, ঋণের সুদ ও ডলারের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে আমদানি ও রপ্তানি থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকের কাছে কত দরে ডলার কেনাবেচা করা হবে, এত দিন তা ঠিক করত বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)।
মার্জার কি ভেস্তে গেলো?
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) হিসাব করে বলছে, গত ১৫ বছরে আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে লুটপাট হয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। দেশের ব্যাংক খাত এখন পরিণত হয়েছে অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্র হিসেবে। আর প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি হয়ে পড়েছে দুর্বল।
এরই মধ্যে ব্যাংকিং খাতে শৃংখলা ফেরাতে ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ১৭ দফা রোডম্যাপ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই রোডম্যাপের আলোকে দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত বা মার্জার করার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ১৪ মার্চ দুর্বল পদ্মা ব্যাংক ও সবল এক্সিম ব্যাংক একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সে সিদ্ধান্তের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের উপস্থিতিতে দুই ব্যাংকের মধ্যে একটি সমঝোতাও হয়।
এর পর গত ৩ এপ্রিল সরকারি খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ৮ এপ্রিল সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে এবং ৯ এপ্রিল বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। একীভূত করার কোনো সিদ্ধান্তই স্বেচ্ছায় নেওয়া হয়নি, বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাধ্য করেছে।
বেসিক ব্যাংক সিটি ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার হবে না বলে আগেই জানিয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ইউসিবির সঙ্গে একীভূত হবে না—সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চার মাস আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গঠন করে দেওয়া পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
সেই পর্ষদও বলছে, তারা কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে না। সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সংকটে সিদ্ধান্তে তালগোল
অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বাংলাদেশ যে উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করতে পেরেছিল, তার প্রধান কারণ সামষ্টিক অর্থনীতি ছিল স্থিতিশীল। অথচ সেটাই এখন হুমকির মধ্যে।”
সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেখে হতাশ ইভেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।
তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “কী হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। সুদের হার বেড়ে গেলে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান টিকে থাকবে কী করে? এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের সব প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমে গেছে। মানুষের আয় বাড়েনি; পণ্যের দাম বেড়েছে। বিক্রি কমার এটাই একমাত্র কারণ।
“অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়তে বাড়তে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে; বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সব মিলিয়ে কোনও প্রতিষ্ঠান তার পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারছে না। ঋনের উচ্চ সুদের সাথে সাথে ব্যাংকগুলো বন্ডে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। বিনিয়োগে মন্দা দেখা দিয়েছে। পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এই পরিস্থিতিতে শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।”
উচ্চ মূল্যস্ফীতির তথ্য দিয়ে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেছিলেন, নিম্ন আয়ের মানুষ এখন অসুবিধায় রয়েছে।
মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে মাছ ও মুরগির দামের বড় ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন তিনি।
সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে বড় প্রভাব রাখছে ডলারের উচ্চ দর। ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। এর ফলে আমদানি করা সব পণ্যের দাম গেছে বেড়ে।
কোভিড মহামারির রেশ বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছিল বাংলাদেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কাও সামাল দেওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু এবছরের শুরু থেকে অর্থনীতির কোনও কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে না। সরকার উন্নয়নের গল্প ফলাও করে প্রচার করতে যতটা মনোযোগী, সংকট মোকাবেলার কাজটিতে ততটাই উদাসীন।
প্রণোদনা ও ডলারের দর বাড়ায় রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি হলেও রপ্তানিতে ১০ মাসে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এই সময়ে আমদানি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে সবচেয়ে বড় অস্বস্তি হয়ে দেখা দিচ্ছে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি, যা ৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
রাজস্ব আদায়ের চিত্রও হতাশাজনক। নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) যে তথ্য প্রকাশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), তাতে ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা দিলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম।
সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাস্তবায়ন হয়েছে ৪২ শতাংশ। লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বাকি তিন মাসে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা খরচ করতে হবে।
চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ২ লাখ টাকা। তবে তা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৩১৪ কোটি (৩.১৪ বিলিয়ন) ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) দেশে এসেছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে করুণ দশা এবং অব্যাহত ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপ নেয়। তার সুফলও মেলে, আমদানি ব্যয় বেশ কমে আসে। তবে আমদানি কমলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমবে, অর্থনীতি সেটাই বলে।
আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানার প্রভাবে শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির উপরও পড়ছে। এতে শিল্প উৎপাদন কম হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে না। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব।
খেলাপি ঋণের ভারে জর্জর ব্যাংক খাতের চিত্র সবচেয়ে উদ্বেগের। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই অঙ্ক এখেন ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) হিসাব করে বলছে, গত ১৫ বছরে আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে লুটপাট হয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। দেশের ব্যাংক খাত এখন পরিণত হয়েছে অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্র হিসেবে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে ব্যাংক খাত।
একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে ৬/৭টি ব্যাংক। সেটাও উদ্বেগের চোখে দেখছে অর্থনীতিবিদরা।
ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সম্প্রতি ১৭ দফা রোডম্যাপ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আলোকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও দেখা দিয়েছে জটিলতা।
রিজার্ভের পতন ঠেকাতে ঋণ পেতে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় সরকার। ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দুটি কিস্তি এরমধ্যে পেয়েও গেছে বাংলাদেশ। তবে এর দামও দিতে হচ্ছে সরকারকে। নানা ধরনের করছাড় কমানো, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা, ভর্তুকি হ্রাসের মতো শর্ত নিতে হচ্ছে মেনে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদের চোখে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় চারটি উদ্বেগ। সেগুলো হলো- চলতি হিসাবে বড় ঘাটতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া ও টাকার অবমূল্যায়ন, দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রাজস্ব আহরণ কম হওয়া।
গত মঙ্গলবার ঢাকায় এমসিসিআই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি উদ্বেগগুলো চিহ্নিত করে বলেন, এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সরকারের নেওয়া কিছু ভুল নীতি ও সঠিক পদক্ষেপের অভাবই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন আহসান মনসুরও। তিনি টাকা-ডলারের বিনিময় হার পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু এবং সুদের হার ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়ার নতুন সিদ্ধান্তের কথা বলেন।
“আমি মনে করি, এই দুটি সিদ্ধান্ত দুই বছর আগেই নেওয়া দরকার ছিল। আমরা বার বার বলেছিলামও। যাই হোক শেষ পর্যন্ত যে বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝতে পেরেছে সেটা মন্দের ভালো।”
ব্যাংক খাতকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে বড় ধাক্কা দেওয়া প্রয়োজন মনে করেন তিনি।
“সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। দুর্বল ব্যাংক মার্জার করে কিন্তু সফল হবে না। বিকল্প কিছু ভাবতে হবে।”
বিনায়ক সেন মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সুদহার বাড়ানো বা এ রকম পৃথক পদক্ষেপ নিলে হবে না। এর সঙ্গে শুল্ক কমানোসহ বেশ কিছু সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আবার অন্য খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
তিন সপ্তাহ পরই নতুন অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। তাই আগের মতো ভুল না করে বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে পরামর্শ দেন আহসান মনসুর।
তিনি বলেরন, “বাজেটটা অবশ্যই ছোট হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর সেটা বাজেটের মাধ্যমে করতে হবে।”
কমেন্ট