খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের দিকে ছুটছে

খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের দিকে ছুটছে

বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য থাকলেও তা সম্ভব হয়নি; গত ১৫ মাস ধরে অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচক ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।

দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক মূল্যস্ফীতির পারদ ফের চড়েছে। এপ্রিল মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাজেটের আগে মে মাসে তা ফের বেড়েছে। এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি তো বেড়েছেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের দিকে ছুটছে।

বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য থাকলেও তা সম্ভব হয়নি; গত ১৫ মাস ধরে অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচক ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।

আগামী ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন। ৩০ জুন সেই বাজেট পাস হবে।

সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সোমবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।

আগের মাস এপ্রিলে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ; যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

মে মাসে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২৩ সালের মে মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, গত মে মাসে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৮৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

আর ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২৩ সালের মে মাসে দেশের মানুষ যে খাদ্য ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের মে মাসে সেই খাদ্যের জন্য ১১০ টাকা ৭৬ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

৩০ জুন চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হবে। এই অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে সাবিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

দ্বিতীয় মাস আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে ওঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

পরের মাস সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হার ছিল ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।

অক্টোবরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।

পরের মাস নভেম্বরে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।

ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে আসে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে নেমে আসে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে।

এর পর গত কয়েক মাস খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বাড়লেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের (দু্ই অঙ্কের) নিচেই ছিল। এপ্রিলে এসে তা ফের দুই অঙ্কের ঘরে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে উঠে। মে মাসে তা আরও বেড়ে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে উঠেছে।

তবে গত ৯ মে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে চালঞ্চ্যকর তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ।

বিআইডিএসের একটি জরিপের তথ্য প্রকাশ অনুষ্ঠানে মহাপরিচালক বিনায়ক সেন এ কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, বাড়তি এ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ অসুবিধায় রয়েছে।

বিনায়ক সেন বলেন, “সম্প্রতি বিআইডিএসের পক্ষ থেকে দেশের সব জেলা থেকে তথ্য নিয়েছি। এরপর একটি পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৫ শতাংশ।”

সাধারণত মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস। তবে বিআইডিএস পৃথক পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির এই হিসাব করেছে।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, “আমাদের পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। গত এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। এরপর রয়েছে পোল্ট্রি মুরগির দাম।”

বিনায়ক সেন মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সুদহার বাড়ানো বা এ রকম পৃথক পদক্ষেপ নিলে হবে না। এর সঙ্গে শুল্ক কমানোসহ সমন্বিতভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি বলেন, পোল্ট্রি খাদ্যে শুল্ক কমানো প্রয়োজন। এটি কমানো হলে তা মাছ ও মুরগির মতো পণ্যের দাম কমাতে সহায়ক হবে। এতে মূল্যস্ফীতিও কমবে। এ খাতে শুল্ক কমিয়ে অন্য খাত থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে।

১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি শতাংশের বেশি

গত বছরের মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশে ওঠে। এরপর তা আর কোনো মাসেই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। অর্থাৎ ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।

গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে ওঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল।

পরের মাস সেপ্টেম্বরে অবশ্য সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমে আসে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল নেমে আসে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশে।

অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে ওঠে; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৭৩ শতাংশ

১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে) দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

গত অর্থবছরের একই সময়ে (২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের মে) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) শেষ হয়েছিল।

তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।

কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।

২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পর তা দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) নিচে নেমে আসে। ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সূচক ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।

লক্ষ্য ছিল ৬ শতাংশে আটকে রাখা

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে। বাজেট ঘোষণার পর থেকেই দেশের সব অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলে আসছে বাজারের যে অবস্থা তাতে সরকারের এই আশা কখনই পূরণ হবে না।

দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই সোয়া দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেশ দ্রুত গতিতে কমলেও বাংলাদেশে কমার তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এমন কি অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি কমে ৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে দুই বছর ধরে। যার আওতায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তারপরও মূল্যস্ফীতি কমেনি।

বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামীলীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনও মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছিল। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি চড়তে থাকে।

গ্রামে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ

মে মাসে পল্লী এলাকায় বা গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশে উঠেছে। এপ্রিলে গ্রামে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। মে মাসে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশে উঠেছে। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।

মে মাসে শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।

সিদ্ধান্তে তালগোল, খেসারত দিচ্ছে অর্থনীতি পরবর্তী

সিদ্ধান্তে তালগোল, খেসারত দিচ্ছে অর্থনীতি

কমেন্ট