শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন শূন্যের কাছে, বাংলাদেশের ১১.৬৬ শতাংশ

শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন শূন্যের কাছে, বাংলাদেশের ১১.৬৬ শতাংশ

২০২২ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কায় পণ্যের উচ্চমূল্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাতে পোড়া পাউরুটি হাতে এক প্রতিবাদকারী। ছবি: এএফপি

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়; দুই বছর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি চড়তে চড়তে প্রায় ৭০ শতাংশে উঠেছিল। ব্যাপক জনরোষে পতন ঘটেছিল সরকারের। অবিশ্বাস্য তথ্য হচ্ছে—আগস্টে সেই মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

অর্থাৎ দুই বছরের মাথায় বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে এনেছে দ্বীপদেশটি।

অথচ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি চড়ছেই। ২০২২ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এই জুলাইয়ে তা ৪ দশমিক ১৮ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ১২ আগস্ট মূল্যস্ফীতির সবশেষ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

২০২২ সালের ১২ জুলাই রাতে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ও তার পরিবার দেশ ছেড়ে যখন পালিয়েছিলেন তখন প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছিল জনতা।

বাংলাদেশে এবার সরকার পতন অনেকটা তেমনই হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর তার সরকারি ভবনেও ঢুকে শ্রীলঙ্কার মতোই উল্লাসে ফেটে পড়েছিল জনতা।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মূল কারণ চাকরিতে নিয়োগে কোটা নিয়ে হলেও মূল্যস্ফীতিও বাড়ছিল তরতরিয়ে। জুলাইয়ে তা ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছে।

অন্যদিকে এখন শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ দুই বছরের মাথায় অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচক ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে এনেছে প্রতিবেশী দেশটি।

আর বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি চড়ছেই, যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত ১২ আগস্ট সবশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়।

২০২২ সালের জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এই জুলাইয়ে তা ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছে।

শুক্রবার শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বড় সফলতা অর্জন করেছে শ্রীলঙ্কা।

২০২২ সালের বিপর্যয় ঠেকিয়ে গত বছরের অর্থাৎ ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ শতাংশ; চলতি বছরের জুলাই মাসে যা ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ। সেখান থেকে একধাপে তা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

খাদ্য থেকে শুরু করে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য- সবকিছুর দাম আগস্ট মাসে কমেছে শ্রীলঙ্কায়। গত জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কায় বিদ্যুতের দাম ২২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। সেই সঙ্গে পানি, জ্বালানি ও রান্নার গ্যাসের দাম কমেছে। মূলত এসব কারণে আগস্ট মাসে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এতটা কমেছে।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চলতি বছরের আগস্ট মাসে গৃহায়ণ, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানির দাম জুলাই মাসের তুলনায় কমেছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। জুলাই মাসেও জুনের তুলনায় দাম কমেছিল শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ।

তবে শিক্ষায় মূল্যস্ফীতির হার এখনও অনেকটা বেশি, ৭ দশমিক ২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে অ্যালকোহলভিত্তিক বেভারেজ ও তামাক পণ্যে। এসব পণ্যের দাম বেড়েছে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া যোগাযোগ ও পরিবহন খাতের মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৫ ও ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

আগামী ২১ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কার সাধারণ নির্বাচন; সেই নির্বাচনের আগে পণ্যমূল্য খুব একটা বাড়বে না বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

কীভাবে কমাল শ্রীলঙ্কা

২০২২ সালে ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে জোর দেয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, তার ফল পেতে শুরু করেছে দেশটি।

টানা পাঁচ প্রান্তিকে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হওয়ার পর ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। তখন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ। সে বছরের শেষ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) প্রবৃদ্ধির হার আরও বেড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়। টানা দুই বছর অর্থনৈতিক সঙ্কোচনের পর চলতি বছর সামগ্রিকভাবে দেশটি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতি পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। ফলে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। জুলাই মাসের শেষে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৫৭০ কোটি ডলার; ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৪৪০ কোটি ডলার।

অর্থাৎ সাত মাসে রিজার্ভ বেড়েছে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১৩০ কোটি ডলার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং অর্থ পাচার বন্ধ হওয়া।

মূল্যস্ফীতির বাড়বাড়ন্তের কারণে ২০২২ সালে শ্রীলংকার অর্থনীতির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়। চরমে পৌঁছায় জ্বালানি সংকট। পেট্রল পাম্পগুলোয় অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যেও মিলছিল না খাদ্য ও জ্বালানি। রিজার্ভ সংকটে দেউলিয়া শ্রীলংকার বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল মূল্যস্ফীতি। ওই অবস্থা থেকেও দেশটির উঠে আসাটা অনেকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে।

শ্রীলঙ্কার এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ৬৪ বছর বয়সী পি নন্দলাল বীরাসিংহে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে তিনি কয়েক বছর আগেই শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করেছিলেন। তখন তিনি শ্রীলঙ্কার উপ গভর্নর ছিলেন তিনি। কিন্তু তখন তার সতর্কবার্তাগুলো দেশটির সরকার আমলে নেননি।

এমন অবস্থায় আগাম অবসর নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান নন্দলাল। তবে শ্রীলঙ্কা চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়ার পর দেশটিকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের জন্য আবারও তাকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে ১৩ বছরে সর্বোচ্চ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশে গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে গত জুলাই মাসে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাসটিতে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে যায়।

সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও যেন লাফ দিয়ে বেড়ে গেছে।

সরকার পতনের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার গঠিত হয়েছে, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নতুন সরকার গভর্নরও পাল্টেছে। এই দায়িত্বে এসেছেন অর্থনীতি গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

বিবিএসের হিসাবে, গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুলাই মাসে বেড়ে ১৪ শতাংশ ছাড়াল। যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিবিএসের হিসাবে, এর আগে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এরপর গত জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ।

দীর্ঘদিন ধরে বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলছেন, সরকারি পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে, বাস্তবে সেটি আরও বেশি। সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের এ অবিশ্বাসের মধ্যেও এক বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এত দিন শঙ্কা ছিল মূল্যস্ফীতির তথ্য কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য হয়ত এটা করা হয়েছিল। কারণ বাজারের জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির তথ্য মিলছিল না।

“এখন রাজনৈতিক সরকার নেই। তাই মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। জুলাই মাসে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এর প্রতিফলনও দেখা গেছে মূল্যস্ফীতির হিসাবে।”

শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসার কারণ জানতে চাইলে সেলিম রায়হান বলেন, “উত্তর একটাই। শ্রীলঙ্কা যা করেছে, আমরা তা করিনি। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তভাবে সবকিছু মোকাবেলা করেছে; আমরা করিনি। উল্টো একটার পর একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়েছি। যারি মাশুল দিতে হচ্ছে।”

“তবে এখন নতুন সরকার এসেছে। নতুন গভর্নর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছেন। আশা করছি সুফল পাওয়া যাবে।”

ধাক্কার পর ধাক্কা, কোথায় দাঁড়িয়ে অর্থনীতি পরবর্তী

ধাক্কার পর ধাক্কা, কোথায় দাঁড়িয়ে অর্থনীতি

কমেন্ট