মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছেই, শিল্পে প্রভাব কী

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছেই, শিল্পে প্রভাব কী

আগামী দিনগুলোতে কী হবে– এ নিয়ে চিন্তার মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা। সবার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

ডলার সংকট থেকে এখনও বের হতে পারেনি বাংলাদেশ। নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়– এমন পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করেই চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার পরও ডলার সংকট কাটছে না; বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ফের ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

এদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটও প্রকট হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। শ্রমিক অসন্তোষ-বিক্ষোভে দুইশ’র বেশি কারাখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

আগামী দিনগুলোতে কী হবে– এ নিয়ে চিন্তার মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা। সবার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর এসব কারণে দেশে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। ফলে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ মন্থর হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার পণ্য আমদানির সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাাসে (জুলাই-আগস্ট) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন বাংলাদেশের শিল্পদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কম।

২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য প্রায় দ্বিগুণ ৫০ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের এলসি খুলেছিলেন শিল্পোদ্যোক্তারা।

এর অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা কলকারখানা স্থাপন বা সম্প্রসারণে আগের চেয়ে যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন, যা দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে দেশে শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমবে। আর বিনিয়োগ কমা মানে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির যে আবহ দেখা দিয়েছিল, তা হোঁচট খেয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতির গবেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (১২ মাস, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২৬৩ কোটি ১৪ লাখ (২.৬৩ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন উদ্যোক্তারা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২১) চেয়ে ১১ শতাংশ কম।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৮৫ কোটি (৪.৮৫ বিলিয়ন) ডলারের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছিল, যা ছিল তার আগের বছরের (২০২১-২২) তুলনায় ১১ দশমিক ৩ শতাংশ কম।

২০২১-২২ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য রেকর্ড ৬৪৬ কোটি ৩৭ লাখ (৬.৪৬ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন উদ্যোক্তারা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।

শুধু মূলধনি যন্ত্রপাতি নয়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) পণ্য আমদানিতে সামগ্রিক এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। এই দুই মাসে পণ্য আমদানির জন্য সব মিলিয়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার।

এই দুই মাসে শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলার পমিাণ কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। ৭৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের এই পরিমাণ ছিল ৮১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।

২০২২ সালে ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে ডলারের সংকট দেখা দেয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যায়। গত বছর থেকে অবশ্য বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। তবে বাংলাদেশে ডলার-সংকট দূর হচ্ছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়েও দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতিও ১০ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে। বেড়েই চলেছে এই মুদ্রার দর। বিপরীতে কমছে টাকার মান। এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি। তিন বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ৪১ দশমিক ৫০ শতাংশ।

২০২১ সালের আগস্টে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার-টাকার বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ ওই সময় ১ ডলার কিনতে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা লাগত। বৃহস্পতিবার লেগেছে ১২০ টাকা।

এক বছর আগে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ লফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। যার চাপ পড়ে অর্থনীতিতে।

আমদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রপ্তানি ও রেমিটেন্স না বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমতে থাকে। ২০২১ সালের আগস্টে যে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, কমতে কমতে সেই রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

বৃহস্পতিবার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।

এক বছর আগে গত বছরের ১১ সেপ্টম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই দিন ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। ১২ জুলাইয়ের আগে শুধু ‘গ্রস’ হিসাবের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক।

পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দর বৃদ্ধি– একের পর এক ধাক্কায় বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক শিল্পের অস্থিরতা আমাদের আরেক চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এমন চলতে থাকলে তো শুধু ক্যাপিটাল মেশিনারি নয়, সব কিছুর আমদানিই কমবে। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমা মানে, ভবিষ্যতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, একটি কঠিন সময় পার করছি আমরা। ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।”

দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নতুন সরকার আসার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “স্বাভাবিক কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছেন। পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হবে, তখন আবার আমদানি করবেন। কিন্তু কবে স্বাভাবিক হবে, সেটাই এখন বড় বিষয়।”

শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন শূন্যের কাছে, বাংলাদেশের ১১.৬৬ শতাংশ পরবর্তী

শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন শূন্যের কাছে, বাংলাদেশের ১১.৬৬ শতাংশ

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর