সংকটেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে কেন
সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ার তিনটি কারণ খুঁজে বের করেছেন অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধি, ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়া এবং দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে মন্দাবস্থার কারণে মানুষ এখন ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
অর্থনীতিতে সংকট চলছে; মানুষের মধ্যে স্বস্তি নেই। বাজারে গিয়ে বাড়তি টাকা গুণে দিশেহারা সবাই। সরকারি হিসাবেই দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি—১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
এই উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমে গেছে। কিন্তু অবাক করা তথ্য হচ্ছে—হঠাৎ করেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পুরো সময়ে (১২ মাস, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি ছিল ২ হাজার ১১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা নেগেটিভ বা ঋণাত্মক (-)। অর্থাৎ গত অর্থবছরে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার চেয়ে ২ হাজার ১১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেশি সুদ-আসল বাবদ সরকারের কোষাগার থেকে পরিশোধ করতে হয়েছিল।
অথচ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই তিন মাসে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধের পরও সরকারের কোষাগারে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমা ছিল; এই টাকা টাকা সরকার ঋণ হিসেবে নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেশ কমে গিয়েছিল; বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধে ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা বেশি চলে গিয়েছিল।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের এই তথ্যই বলছে, গত দুই অর্থবছরে (২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪) সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার; উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল কোষাগারে থেকে পরিশোধ করেছে।
হঠাৎ করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ার তিনটি কারণ খুঁজে বের করেছেন অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধি, ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়া এবং দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে মন্দাবস্থার কারণে মানুষ এখন ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
গত বৃহস্পতবার প্রকাশিত সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মানে হচ্ছে—এই তিন মাসে মোট যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা থেকে আগে বিক্রি হওয়া সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসলা পরিশোধের পর ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা ছিল; এই টাকা সরকার তার প্রয়োজন মাফিক খরচ করেছে।
অথচ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। তার মানে হচ্ছে—ওই তিন মাসে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার সঙ্গে ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা যোগ করে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল ধণাত্মক (+)। অর্থাৎ যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধের পরও সরকারের কাছে অবশিষ্ট থেকে।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৮৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ধণাত্মক (+)। দ্বিতীয় মাস আগস্টে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে নিট বিক্রি ছিল জুলাই-আগস্ট দুই মাসের বিক্রির প্রায় দ্বিগুণ ৪ হাজার ১০৯ কোটি ৯ লাখ টাকা।
বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তার পরও বাড়তে থাকে বিক্রি।
সর্বশেষ সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এর পর থেকে বিক্রি কমতে থাকে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।
নানা ধরনের কড়াকড়ি, সুদের হার হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের সঞ্চয়ে টান পড়ায় বিক্রি কমে যাওয়ায় এই খাত থেকে কাঙ্খিত ঋণ পাচ্ছিল না সরকার। সে কারণে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য কমিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
কিন্তু অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে এক টাকাও ঋণ পায়নি সরকার; উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ না পাওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। কিন্তু গত অর্থবছরের এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারেনি সরকার। উল্টো ২১ হাজার ১২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা কোষাগার থেকে গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে।
এর আগে ২০২১–২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছিল সরকার। ২০২০–২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি—৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা তিন মাসেই (অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর) নেওয়া হয়ে গেছে।
বর্তমানে ব্যাংকগুলো স্থায়ী আমানতে ৯ থেকে ১১ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। তবে কোনও কোনও ব্যাংক ১৩ শতাংশ পর্যন্ত স্থায়ী আমানতে সুদ দিচ্ছে।
অন্যদিকে, ৩ মাস মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেওয়া হচ্ছে ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, পূর্ণ মেয়াদে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ, ৫ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ও পেনশন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
তিন কারণে বাড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি
হঠাৎ করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কেনো বাড়ছে—এ প্রশ্নের উত্তরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সুদের হার বেশি হওয়ায় বেশ কিছুদিন ধরেই আইএমএফ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমাতে বলে আসছিল। আইএমএফের পরামর্শে কয়েক দফায় সুদের হার বেশ খানিকটা কমানো হয়েছে। নানা ধরনের কড়াকড়িও আরোপ করা হয়েছে। সে কারণেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে মতো ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি নেগেটিভ (-) ছিল।”
“এখন মূল্যস্ফীতি বেশি; মানুষের খরচ বেড়েছে। সঞ্চয় করতে পারছে না। তার পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় পেছনে তিনটি কারণ আছে বলে আমার মনে হচ্ছে। প্রথমত—আমরা সব সময়ই দেখেছি, রেমিটেন্সের একটি অংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়ে থাকে। প্রবাসীরা যাদের কাছে টাকা পাঠান, তারা প্রয়োজনীয় খরচ বাদে যেটা সঞ্চয় করেন, সেটা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনেন। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিটেন্স অনেক বেড়েছে। সে কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে।”
“দ্বিতীয়ত—ব্যাংকিং খাতে এখন খুবই খারাপ অবস্থা। অনেক ব্যাংক আমানতকারীতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। সে কারণে আমানতের সুদের হার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেলেও মানুষ এখন আর কোনো ব্যাংকেই টাকা রাখছে না। যতোটুকু সঞ্চয় থাক না কেনো, তা দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত সঞ্চয়পত্র কিনছে।”
“আর তৃতীয় কারণ হচ্ছে—পুঁজিবাজারের নাজুক অবস্থা। দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে। ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সবাই আশা করেছিল, নতুন সরকার এসেছে বাজার ভালো হবে; তাও হচ্ছে না। তাই সবাই এখন সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুকেছে।”
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের পর চলতি অক্টোবর মাসেও বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ৮৯৪ (৮.৯৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিটেন্সে এমন প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
কমেন্ট