সেই শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি এখন শূন্যের নিচে -১.৭%, বাংলাদেশে ১১ শতাংশ

সেই শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি এখন শূন্যের নিচে -১.৭%, বাংলাদেশে ১১ শতাংশ

২০২২ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কায় পণ্যের উচ্চমূল্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাতে পোড়া পাউরুটি হাতে এক প্রতিবাদকারী। ছবি: এএফপি

দুই বছর আগের কথা; ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৬৯ দশমিক ৮০ শতাংশে। বাংলাদেশে তখন ১০ শতাংশের নিচে, ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। অবিশ্বাস্য তথ্য হচ্ছে—সেই শ্রীলঙ্কায় এখন মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক (-), আর বাংলাদেশে বাড়তে বাড়তে ১১-১২ শতাংশের ঘরে ঘোরাফেরা করছে।

আর এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে দ্বীপ রাষ্ট্রটি। বিপরীতে বাংলাদেশে সংকট ঘনিয়ে আসছে। দিন যতো যাচ্ছে, সংকট ততোই বাড়ছ।

এই দুই বছরে শ্রীলঙ্কার মুদ্রা রুপির দরবৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম কমানো হয়েছে, তার হাত ধরে মূল্যস্ফীতির এই অধঃগতি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসেও মূল্যস্ফীতির হার ঋণাত্মক থাকতে পারে। এরপর গাড়ি আমদানি শুরু হলে বিদেশি মুদ্রার চাহিদা বাড়তে পারে। তখন মূল্যস্ফীতির হার আবার শূন্যের ওপরে যাবে, যদিও তা ৪ শতাংশের ওপরে যাবে না।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, গত চার মাস ধরে দেশটিতে কোনো মূল্যস্ফীতি হচ্ছে না; বরং মূল্য সংকোচন হয়েছে। অর্থাৎ নেগেটিভ (-) মূল্যস্ফীতি হচ্ছে।

ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে গত আগস্টে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। সেপ্টেম্বরে তা মাইনাস শূন্য দশমিক ২ (-০.২) শতাংশে নামে। অক্টোবর ও নভেম্বরে এই হার ছিল মাইনাস শূন্য দশমিক ৭ (-০.৭) ও মাইনাস ১ দশমিক ৭ (-১.৭) শতাংশ।

সবশেষ ডিসেম্বরেও মাইনাস ১ দশমিক ৭ (-১.৭) শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়।

অথচ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমছে না; কমার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বর্তমান পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেজনক সূচক মূল্যস্ফীতি কমবে-কমবে বলে বার বার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

সরকারি হিসাবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।

আগের মাস নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এমনকি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে নাজেহাল পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতিও নিম্মমূখি হয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে দেশটির মূল্যস্ফীতি প্রায় ৫০ শতাংশে উঠেছিল।

পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে (১০ শতাংশের নিচে) নেমে আসে। ডিসেস্বরে সেই মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে।

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান নয়, বিশ্বের সব দেশের মূল্যস্ফীতির পারদই কমছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৪ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, পাঁচ থেকে ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে। এর পরও তিনি একাধিকবার একই কথা বলেছেন। পাঁচ মাস পার হয়ে গেছে; কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

উল্টো শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, শুল্ক ও কর বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে দেশের প্রায় সব অর্থনীতিবিদ মনে করছেন।

অবিবেচনাপ্রসূতভাবে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে প্রত্যক্ষ করে মনোযোগ দেওয়া দরকার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার আগের মতোই পরোক্ষ করে নজর দিচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক।

শনিবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘শ্বেতপত্র ও অতঃপর: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক এক সিম্পোজিয়ামে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্রবিষয়ক কমিটির প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন দেবপ্রিয়।

এই আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গটি তুলে বলেন, “পণ্যমূল্যে আগুন বহির্বিশ্বে নিভে গেলেও বাংলাদেশে নেভেনি। না নেভার কারণও আছে। ফায়ার ব্রিগেড দেরিতে এসেছে। এসে আবার পানি ঢালার বদলে তেল ঢেলেছে। পরে দেখা গেল পাইপেও সমস্যা আছে।”

বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কমবে। এর কারণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে ভাটার টান। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি থাকবে চড়া। সরকারের মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না।

শুক্রবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংক ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ (বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা) শীর্ষক প্রতিবেদনের জানুয়ারি (২০২৫) সংস্করণে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছর নিয়ে এসব পূর্বাভাস তুলে ধরেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি চূড়ায় উঠেছিল ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে। এর পর থেকে তা ধাপে ধাপে কমছে। ভারতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে (শুধু গত অক্টোবর ছাড়া)। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনতে পেরেছে। পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে নেমে আসে।

“বিপরীতে বাংলাদেশেই মূল্যস্ফীতি এখনো চড়া।”

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে খাদ্যের দাম কমায় ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশে।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি হয়নি; বরং মূল্য সংকোচন হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে ডিসেস্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান এআরএইচ ডট নিউজকে  বলেন, “আমাদের জন্য এটা খুবই দুঃখজনক যে, আমরা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমাতে আমরা সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করতে পারছি না।”

“প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। নতুন সরকারকেও খুব ভিন্ন কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না।”

তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করে বর্তমান সরকার তা করতে পারত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সমন্বয় নেই।

“বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে। অন্যদিকে সরকার কর বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এক মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, আরেক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা তা আটকে দিচ্ছে।

“আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমবে, সে আশা করা যায় না। কারণ, বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সবজির দাম কমেছে। তবে তা স্থায়ী না–ও হতে পারে।

সেলিম রায়হান বলেন, “বাংলাদেশ নিম্নমুখী জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো দুটি ক্ষতিকর দিকের মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ কম, অন্যদিকে ব্যয় বাড়ছেই।”

‘কঠিন এই সময়ে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, শুল্ক ও কর বাড়ানো উচিৎ হয়নি’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে।”

অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত শ্রীলংকা ইতোমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বামপন্থী সরকার আসার পর শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার শূন্যের নিচে নামিয়ে আনাসহ অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে দেশটি।

২০২২ সালে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। এরপর ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২৯০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশটি।

মূল্যস্ফীতির বাড়বাড়ন্তের কারণে ২০২২ সালে শ্রীলংকার অর্থনীতির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়। চরমে পৌঁছায় জ্বালানি সংকট। পেট্রল পাম্পগুলোয় অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জন-অসন্তোষ চরমে ওঠে।

দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যেও মিলছিল না খাদ্য ও জ্বালানি। রিজার্ভ সংকটে দেউলিয়া শ্রীলংকার জন্য গত বছর আরো বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল মূল্যস্ফীতি। এ অবস্থা থেকেও দেশটি ফিরে এসেছে বিস্ময়করভাবে।

দুর্দশাগ্রস্ত শ্রীলংকার এ ঘুরে দাঁড়ানো রূপকথার গল্পের মতো শোনালেও অর্থনীতির প্রচলিত নীতির কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমেই এই অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিয়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

শ্রীলঙ্কার এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ৬৩ বছর বয়সী নন্দলাল বীরাসিংহে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে তিনি কয়েক বছর আগেই শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করেছিলেন। তখন তিনি শ্রীলঙ্কার উপগভর্নর ছিলেন। কিন্তু তখন তার সতর্কবার্তাগুলো দেশটির সরকার আমলে নেননি।

এমন অবস্থায় আগাম অবসর নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান নন্দলাল। তবে গত বছর শ্রীলঙ্কা চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়ার পর দেশটিকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের জন্য আবারও তাকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বলা যায়, নন্দলাল বীরাসিংহের নেতুত্বেই শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে কাটিয়ে উঠছে; ৭০ শতাংশে উঠে যাওয়া মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

সালেহ উদ্দিনও ‘চালাই দিলেন’ ভ্যাট! পরবর্তী

সালেহ উদ্দিনও ‘চালাই দিলেন’ ভ্যাট!

কমেন্ট