শেষ দিনে কোরবানির পশুর দামে ধস, মাথায় হাত ব্যবসায়ীদের
শেষ দিনে কোরবানির পশুর দামে ধস, মাথায় হাত ব্যবসায়ীদের। ছবি: এআরএইচ ডটকম
রাজধানী ঢাকায় কোরবানির হাট বসার পর গরুর দাম বেশি বলে অসন্তোষ ছিল ক্রেতাদের; দাম-দরে না বনায় অনেকে না কিনে ফিরে আসছিলেন।
গত রোববার কোরবানির হাট বসার পর থেকে সেই চিত্রই দেখা যাচ্ছিল। বিক্রেতারা অপেক্ষায় ছিলেন, ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে, তত বিক্রি বাড়বে।
ঢাকায় অধিকাংশ বাড়িতে গরু কিংবা ছাগল রাখার স্থান না থাকায় শেষ দিকেই কোরবানির পশু বিক্রি হয় বেশি। বিক্রেতারাও আশা করছিলেন, ঈদের আগের দিন কেনা-বেচা হবে জমজমাট।
কিন্তু তাদের সেই আশার গুঁড়ে বালি দিয়েছে বৃষ্টি; তাতে বদলে গেছে ঢাকার পশুর হাটের চিত্র, ক্রেতা সমাগম কমে যাওয়ায় গরু ব্যবসায়ীদের কপালে পড়েছে ভাঁজ ।
এক রাতের ব্যবধানে গরুর দাম ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে নেমেছে এক লাখ ৩০ হাজারে। আর তিন লাখ টাকা দামের গরু নেমেছে আড়াই লাখ টাকায়।
ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের বড় দুই হাট দনিয়া ও গাবতলী দুই স্থানের চিত্রে কোনো ভিন্নতা ছিল না। দর না পেয়ে অনেক বেপারী হাট থেকে গরু ফিরিয়েও নিয়ে গেছেন।
বুধবার ভোর থেকেই রাজধানীতে থেমে থেমে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে সকালে হাটটিতে ক্রেতার তেমন আনাগোনা ছিল না। তাই অনেক বিক্রেতা হাট থেকে বেরিয়ে রাস্তায়ও গরু-ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় তারাঁ কয়েক দিন ধরে যে দাম চাইছিলেন, আজ সে তুলনায় দামও কমিয়ে দেন।
তবে দুপুরের পর বৃষ্টি কমে এলে হাটে ক্রেতাদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। বিকেল পাঁচটার দিকে গাবতলী হাটে ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়। ক্রেতারা পছন্দের গরু কিংবা খাসি বাছাই করছিলেন। চলছিল দর-কষাকষি। বিক্রেতারাও অযৌক্তিক দাম না বলে যে দামের মধ্যে বিক্রি করবেন, সে রকম দামটাই বলছিলেন।
শেওড়াপড়ার বাসিন্দা মনির উদ্দিন মাঝারি আকারের একটি গরু কেনেন। গরুটির দাম পড়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। গরুটি কেনার সময় তাকে বিক্রেতার সঙ্গে খুব বেশি সময় দরদাম করতে দেখা যায়নি।
গরু কেনা শেষে তিনি এআরএইচ ডটকমকে বলেন,, মঙ্গলবার মোহাম্মদপুরের বছিলা, হাজারীবাগ, মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং হাটে গিয়েছিলেন। সেদিন এমন আকারের গরুগুলোর দাম চাওয়া হয়েছিল আড়াই লাখ টাকার মধ্যে। গাবতলী হাটেও এমনই দাম ছিল। আজকে এসে কমে পেয়েছেন, পছন্দ হওয়ায় কিনেও নিয়েছেন।
রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত শেষবারের মতো গাবতলী হাটের পুরো এলাকা ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। এ সময় হাটের স্থায়ী অংশের গরু রাখার জায়গাগুলোতে অনেক গরু অবিক্রীত অবস্থায় রয়ে যেতে দেখা গেছে। পাইকারদের অনেকেই ওই সময়ে নিজেদের মতো গল্প-আড্ডায় ব্যস্ত ছিলেন। অনেকে আবার ক্রেতার উপস্থিতি নিয়ে হতাশার কথা জানান।
গাবতলী হাটের নিয়মিত পাইকার রমিজ মিয়া বলেন, “হাটে সারা বছরই গরু নিয়ে আসি। কোরবানির সময় এই হাটেই প্রতিবছর গরু আনি। এবারও ২৭টি গরু নিয়ে এসেছিলাম। বিক্রি হয়েছে মাত্র ৯টি।’ তিনি বলেন, এখনই যেভাবে ক্রেতা কমে গেছে, তাতে মনে হচ্ছে না বাকি রাতটুকুতে গরুগুলো বিক্রি হবে। এ বছর ক্রেতা অনেক কম।”
অনেক ক্রেতা গরু রাখার নির্ধারিত জায়গা ছেড়ে এসে গাবতলীর হাটের হাসিলঘরের সামনে গরু নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাটে ক্রেতাদের ঢুকতে দেখলেই ডেকে নিজের গরুটির দাম বলছিলেন। কোনো কোনো পাইকারকে আবার ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বলতে শোনা যায়, ‘স্যার, একটাই গরু আছে। কেনা দামে ছাইড়া দিমু।’
গাবতলীর হাটে পর্যাপ্ত গরু অবিক্রীত থাকার পাশাপাশি আকারে বড়—এমন গরু একেবারেই কম বিক্রি হয়েছে। বিক্রি করতে না পেরে কোনো কোনো খামারিকে গরু নিয়ে এলাকার উদ্দেশে রওনা দিতেও দেখা গেছে।
যাত্রাবাড়ী পেরিয়ে মহাসড়কের পাশে কাজলা-দনিয়ার খালি জায়গায় অস্থায়ী হাটে বুধবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত থেকে দেখা গেছে, বৃষ্টিতে জমে থাকা জল-কাদা এড়িয়ে ক্রেতারা তুলনামূলক শুকনা ও সড়কে থাকা গরুর দর কষাকষি করছেন।
বেপারীরা বলছেন, এখন মুনাফা তো দূরের কথা, খরচ ওঠানোর চেষ্টা করছেন তারা। অনেকেই লোকসান দিয়ে বেচছেন গরু।
বেলা ১১টায় ১০ হাজার টাকা লোকসান দিয়ে হাতে থাকা সর্বশেষ গরু বিক্রি করেছেন মৌসুমী ব্যবসায়ী রতন সরকার।
তিনি বলেন, “হাটে ক্রেতা নাই, বৃষ্টির কী হবে, তা জানি না। এখনও অনেক গরু হাটে আছে। তাই লোকসান যাতে আর বেশি না হয় ৯৫ হাজারে বিক্রি দিলাম।”
রতন জানান, মঙ্গলবার রাতেও এক লাখ ১০ হাজার টাকা দাম উঠেছিল তার এই গরুটির। লাভের আশায় তখন বিক্রি করেননি। বুধবার সকাল থেকে কেউ আর ৯০ হাজার টাকার বেশি দাম বলেনি।
‘পাবনাইয়া’ জাত হিসেবে পরিচিত বকনা গরু হাটে নিয়ে এসেছেন ফরিদপুর সদর উপজেলার চন্দ্রাপুরের আকমত হোসেন।
তিনি বলেন, “মঙ্গলবার রাতেও এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দাম উঠেছিল গরুটির। আরও ১০ হাজার চাইছেলাম, বিক্রি হয়নি। আর আইজ সকালে ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি কেউ কয় না।"
ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ১৪টি গরু নিয়ে এসেছেন নুরু মিয়া। এর মধ্যে বিক্রি হয়নি ৫টি। আগেরগুলো লাভে বিক্রি করতে পারলেও এখন দুশ্চিন্তা বাকি গরুগুলো নিয়ে।
গত ৭-৮ বছরে ধরে দনিয়ার এ অস্থায়ী হাটে কোনো গরু অবিক্রিত থাকেনি বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এবার পরিস্থিতি বদলে যেতে দেখছেন।
ভালো দাম পেতে নেত্রকোণা থেকে পাঁচটি গরু নিয়ে বুধবার সকালে দনিয়ায় আসেন ব্যবসায়ী হারুন মিয়া। পৌঁছনোর পর দুশ্চিন্তা ভর করে বৃষ্টি দেখে। কালো রঙের ষাঁড়ের দাম ১ লাখ ১২ হাজার টাকা দাম বললেও বিক্রি করেননি হারুন। অপেক্ষায় আছেন কখন বৃষ্টি ঝরা বন্ধ হবে।
গাবতলীর হাটে দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রচুর গরু দেখা গেলেও ক্রেতা তেমন দেখা যায়নি। সেখানে বিক্রেতাদের হতাশার খবরই শুধু শোনা যাচ্ছিল।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা শামীম ২০টি গরু নিয়ে হাটে এলেও মাত্র ৬টি বিক্রি করতে পারার কথা জানিয়ে বলেন, “বাজারে দাম পড়ে গেছে।”
বগুড়ার শেরপুরের বাবু মোট ১৪টা গরু নিয়ে এসেছিলেন, তার মধ্যে মাত্র চারটি বিক্রি করতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, “বড় গরুর দাম নাই। ৮ লাখ টাকার গরুর দাম চাইছি, ক্রেতা বলছে ৪ লাখ টাকা। আমি সারা বছর একটা গরুর পেছনে যে খরচ করলাম সেই দামই উঠছে না। তাহলে কী করে বিক্রি করব? এখন ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না। পুরো লস।”
কুয়াকাটা থেকে ৭টা বড় সাইজের গরু এনে বিপাকে পড়েছেন আবু সাদেক। তিনি বলেন, “স্যার এত দূর থেকে গরু আনছি একটু লাভের আশায়। ৭টার মধ্যে একটা গরুও বিক্রি করতে পারিনি।”
পাবনা থেকে ১০টি গরু নিয়ে আসা সোলায়মান জানান, বিকালে একটি গরু বিক্রি করেছেন আগের দিনের চেয়ে কম দামে।
“আমার লস হয়েছে। কিছু করাও নেই,” বলেন তিনি।
দাম উঠছে না দেখে অনেক বিক্রেতা গাবতলী হাট থেকে গরু ফিরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড়ও করছিলেন।
বিকাল সাড়ে ৪টায় সিরাজগঞ্জের জহির বলেন, “স্যার কাস্টমার নাই, গরু বিক্রি করতে না পেরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। কী করমু? যে গরু ১ লাখ ৬০ হাজার, সেই গরুর দাম কয় ৯০ হাজার। আমাগো জীবন শেষ।”
মানিকগঞ্জের দেলোয়ার বলেন, “গরুর দাম উঠছিল ১ লাখ ৪০ হাজার। এখন বলে ৮০ হাজার। কেমনে কী করমু। এখন বাড়ি নিয়ে যামু।”
গাবতলী গরুর হাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি আবুল হাশেম বলেন, “বড় গরু বিক্রির ক্রেতা একেবারেই কম। গত দুইদিনে ৬০/৭০টা গরু বেপারীরা ফেরত নিয়েছে।
“মাঝারি ও ছোট গরুর মফস্বলের ক্রেতারাও এখন টোকেনের (ছাড়পত্র) জন্য ভিড় করছে। তারা চলে যেতে চায়। তবে আমরা বলেছি, রাত ১২টার পরে স্লিপ দিয়ে দেব।”
কমেন্ট