গাড়ি কেনা যাবে না, সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ নয়
প্রতীকী ছবি
চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছসাধনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট। এই বাজেটের প্রথম দিন শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি; অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা সব বন্ধ ছিল। সে কারণে নতুন বাজেটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা আসলে শুরু হয়েছে রোববার।
আর এই দিনেই এক পরিপত্র জারি করে অর্থমন্ত্রণালয় সরকারি কর্মকর্তাদের খরচে লাগাম টানার ঘোষণা দিয়েছে। বলা হয়েছে, সরকারি দপ্তরে নতুন সব ধরনের যানবাহন কেনাকাটা বন্ধ থাকবে। পাশাপাশি বিদেশভ্রমণ বন্ধ থাকবে, তবে বিদেশি অর্থায়ন হলে ভ্রমণ করা যাবে।
এ ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় করা যাবে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ টাকা সাশ্রয় করতে হবে।
পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কয়েকটি খাতে ব্যয় স্থগিত ও কমিয়ে আনার কারণ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, করপোরেশন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
সরকারি খরচ কমাতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুতেও যানবাহন, বিদেশভ্রমণসহ বেশ কয়েকটি খাতে ব্যয় স্থগিত করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। যদিও অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে বিদেশভ্রমণে যেতে দেখা গেছে।
তাদের যুক্তি ছিল, বিদেশভ্রমণে সরকারি টাকার সম্পৃক্ততা ছিল না। তারা বিদেশে গেছেন উন্নয়ন সহযোগীদের টাকায়। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গতবার বিভিন্ন কমিটির সম্মানী বাবদ ব্যয় স্থগিত করা হয়েছিল। তবে এবার এখন পর্যন্ত সম্মানী স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়নি।
রোববার জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আবাসিক ভবন, অনাবাসিক ও অন্যান্য ভবন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। ভবন নির্মাণ করে খালি ফেলে রাখায় সরকারপ্রধান বেশ কয়েকবার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
সে জন্য সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে ভবন নির্মাণে কোনো টাকা খরচ করা যাবে না। এ ছাড়া মোটরযান, জলযান ও আকাশযান খাতেও অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে ১০ বছরের পুরোনো মোটরযান প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিতে হবে। ভূমি অধিগ্রহণ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে।
পরিপত্রে আরও বলা হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা যাবে। অর্থাৎ ২৫ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় করতে হবে।
এ ছাড়া গ্যাস ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা যাবে। এ খাতে ২০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় করতে হবে।
পরিপত্রে বলা হয়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সব ধরনের বিদেশভ্রমণ, কর্মশালা ও সেমিনারে অংশগ্রহণ বন্ধ থাকবে। তবে অত্যাবশ্যকীয় বিবেচনায় সীমিত আকারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিদেশি কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠান বা উন্নয়ন সহযোগীর আমন্ত্রণে ও তাদের অর্থায়নে আয়োজিত বিদেশি প্রশিক্ষণে সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশভ্রমণে যেতে পারবেন। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশ থেকে দেওয়া স্কলারশিপ, ফেলোশিপের আওতায় বিদেশি অর্থায়নে মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়ন করতে পারবেন।
এ ছাড়া ঠিকাদার, সরবরাহকারী বা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে সরকারি কর্মকর্তা ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তারা পণ্যের গুণগত মান নিরীক্ষা করার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এক খাতের অর্থ অন্য খাতে পুনঃ উপযোজন করা যাবে না। জারিকৃত এ পরিপত্র অবিলম্বে কার্যকর হবে।
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা সংকটের মধ্যেই শুরু হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর। দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই প্রায় দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহালের মধ্যেই শুরু হলো আরেকটি বাজেট।
১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশাল এই বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’ শিরোনামের এই বাজেট সংসদ সদস্যদের দীর্ঘ আলোচনা শেষে ২৬ জুন পাস হয়েছে। নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
সাধারণত প্রতিবছর ২৯ বা ৩০ জুন বাজেট পাস করে সংসদ। এবার কোরবানির ঈদের ছুটির কারণে কিছুটা আগেভাগে পাস হয়। এ বাজেট সরকারের টানা তিন মেয়াদের ১৫তম এবং চলতি মেয়াদের শেষ এবং বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা। আরও লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এনবিআর বহির্ভূত ২০ হাজার কোটি টাকা ও কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৫০ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৯০ কোটি ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা আহরণ করা হবে।
অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা, ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা সংস্থান করা হবে।
কমেন্ট