৯% গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে শেষ হলো অর্থবছর

৯% গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে শেষ হলো অর্থবছর

সরকারি হিসাবে সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩  অর্থবছরের শেষ মাস জুনে মূল্যস্ফীতির পারদ খানিকটা কমেছে; ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মে মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। 

তবে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি নিয়ে শেষ হয়েছে অর্থবছর। যা বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সোমবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩  অর্থবছরে ১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। 

মে মাস শেষে (২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের মে মাস) এই হার ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। 

২০২১-২২ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হয়েছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। 

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বাজারের যে অবস্থা তাতে এই আশা যে পূরণ হবে না, তা অনেক আগেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল। 

দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই প্রায় দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। 

শেষ পর্যন্ত উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়েই শেষ হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছর। 

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, জুন মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মে মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। 

এর অর্থ হলো ২০২২ সালের জুন মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের জুনে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৭৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। 

মূল্যস্ফীতির এই হার ১২ বছর বা এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়স সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। 

২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামীলীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনও মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছিল। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। 

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি ছুঁটতে থাকে। 

বিবিএসের তথ্য বলছে, জুন মাসে ৯ দশমিক ৭৪ সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। 

এই মাসে শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। 

জুন মাসে পল্লী এলাকায় বা গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। 

২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পর তা দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) নিচে নেমে আসে। এরপর ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সূচক ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি। 

আগস্টে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। এর পর এপ্রিল পর্যন্ত এই সূচক ৯ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। মে মাসে তা এক লাফে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠে। 

যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে সতর্ক করছিলেন অর্থনীতিবিদরা। তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় পুরো অর্থবছর জুড়ে। 

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঠিক এ রকম এক সময়ে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এই দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম।

ফলে পরের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। 

যদিও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। অক্টোবরে তা আরও কমে ৯ শতাংশের নিচে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে আসে। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয় ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা কমে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে নেমে আসে। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে। 

তবে রোজার মাসকে  সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকার কারণে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। 

এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল। 

খাদ্যে মূল্যস্ফীতি 

বিবিএসের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, জুন মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আগের মাস মে’তে হয়েছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। এপ্রিলে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। মার্চে হয়েছিল ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। 

জানুয়ারিতে ছিল ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। অক্টোবরে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। 

খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি 

জুনে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। মে মাসে হয়েছিল প্রায় ১০ শতাংশ; ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এপিলে হয়েছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। মার্চেও এই হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। 

ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। জানুয়ারিতে তা ছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। নভেম্বরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। 

১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। 

দেশের বর্তমান বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে। 

১ জুন বাজেট  ঘোষণার পর থেকেই মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। 

মজুরি সূচক বেড়েছে 

বিবিএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। অক্টোবরে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয় ৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। 

জানুয়ারিতে তা আরও খানিকটা বেড়ে ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশে ওঠে। ফেব্রুয়ারি মাসে হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। 

মার্চ মাসে মজুরি সূচক বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। এপ্রিলে তা বেড়ে হয় ৭ দমিক ২৩ শতাংশ। 

মে মাসে মজুরি সূচক বেড়ে হয় ৭  দশমিক ৩২ শতাংশ। সর্বশেষ জুন মাসে তা আরও খানিকটা বেড়ে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে উঠেছে। 

 

১২ কেজি এলপিজির দাম কমল ৭৫ টাকা পরবর্তী

১২ কেজি এলপিজির দাম কমল ৭৫ টাকা

কমেন্ট