রাজস্ব: এক দশকে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি
প্রতীকী ছবি
বিদায়ী অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি।
অর্থাৎ ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি শুল্ক-কর আদায় হয়েছে দেশে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ লাখ ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
এতে দেখা যাচ্ছে, গেলো অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমে আগের অর্থবছরের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। শুধু তাই নয়, এই প্রবৃদ্ধি এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
তবে, এটি রাজস্ব বোর্ডের সাময়িক হিসাব, যা চূড়ান্ত হিসাবে কিছু কমবেশি হতে পারে।
এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষ করে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে পরের পাঁচ বছর শুল্ক-কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি পৌনে ১১ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে ছিল।
তবে কোভিড মহামারি শুরুর প্রথম বছরে লকডাউনের কারণে তিন মাসের মতো সবকিছু বন্ধ থাকায় রাজস্ব আদায় আগের অর্থবছরের চেয়ে কমে গিয়েছিল।
এনবিআরের প্রবৃদ্ধি এত কমল যখন রাজস্ব আদায় বাড়াতে সবচেয়ে চাপে আছে সংস্থাটি। একদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চাপ, অন্যদিকে সরকারের বাজেটে খরচ বৃদ্ধির জোগান বাড়াতে ধারাবাহিক চাপ। প্রতিবছরই এনবিআরকে বাড়তি রাজস্ব জোগানের জন্য বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু বাস্তবে এত প্রবৃদ্ধি তো হয়ইনি, উল্টো এক দশকের মধ্যে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে। লক্ষ্য থেকে ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফ রাজস্ব আদায়ের জন্য ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি লক্ষ্য দিয়েছিল; সেটিও অর্জিত হয়নি। এর মধ্যে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিয়মিত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে জিডিপির প্রায় আধা শতাংশের সমান বাড়তি শুল্ক-কর আদায়ের শর্ত আরোপ করেছে আইএমএফ।
এনবিআরের সাময়িক হিসাবে দেখা গেছে, আয়কর ও শুল্ক আদায়ে প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে নেমেছে। আয়কর ও ভ্রমণ কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা, এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ।
শুল্ক খাতে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯১ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। এতে প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
তবে ভালো করেছে ভ্যাট খাত। এ খাতে প্রবৃদ্ধি মন্দের ভালো। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ২৭ শতাংশ। যদিও ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আমরা আগেই বলেছিলাম, এবার রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ; তাই হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কোভিডের এক বছর ছাড়া সব অর্থবছরেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও মোটামুটি ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। এবার সেই প্রবৃদ্ধিও ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।”
তিনি বলেন, এনবিআরকে প্রতিবছর তার সক্ষমতার চেয়ে বেশি লক্ষ্য চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যমান করকাঠামো দিয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ এবং বিশাল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বড় লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করতে গিয়ে যারা কর দেয়, তাদের ওপর বাড়তি কর আদায়ের কৌশল নেয় এনবিআর।
“কোভিডের সময় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর রাজস্ব আদায়ে বড় উল্লম্ফন হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এনবিআর এখন রেসের পুরোনো ঘোড়ার মতো হয়ে গেছে। এখন শক্তিশালী ঘোড়া দরকার। বড় ধরনের সংস্কার করেই এনবিআরকে শক্তিশালী ঘোড়ায় পরিণত করতে হবে,” বলেন আহসান মনসুর।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে ডলার–সংকটের কারণে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে আমদানি কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে আয়কর ও ভ্যাট আদায়ে।
জিডিপি বেড়েছে ছয় গুণ, রাজস্ব দ্বিগুণও হয়নি
গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। কিন্তু শুল্ক–কর বা রাজস্ব আদায় দ্বিগুণও হয়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ৭ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে তা বেড়েছে দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।
অর্থনীতি এই বড় হওয়ার পুরো সুফল ঘরে তুলতে পারেনি এনবিআর। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর। ১০ বছরে তা বেড়ে সোয়া ৩ লাখ কোটি টাকা হয়েছে।
কমেন্ট