শেখ হাসিনাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী দেখতে চায় এফবিসিসিআই
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এফবিসিসিআইয়ের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক নেতারা। ছবি-ফোকাস বাংলা
ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায় বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি জসিম উদ্দিন।
শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যবসায়ী সম্মেলন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে এফবিসিসিআই প্রধান বলেন, “আপনি যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেই অবস্থাকে ধরে রাখার জন্য, বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ যেসব সমস্যা রয়েছে ব্যবসায়ীদের সামনে, সেগুলোকে আপনার মাধ্যমে সমাধান চাই। এ জন্য আমরা সব ব্যবসায়ী ঐকমত্য হয়েছি, আপনাকে আবারও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকতে হবে ব্যবসায়ীদের জন্য।”
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি এ কে আজাদসহ সারাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এফবিসিসিআই’র সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরকারকে সঙ্গে পাওয়া গেছে উল্লেখ করে জসিম উদ্দিন বলেন, “যখনই এফবিসিসিআই থেকে আহ্বান করা হয়েছে তখনই আপনি সাড়া দিয়েছেন। এ জন্য আমরা গর্বিত ও কৃতজ্ঞ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে এফবিসিসিআই নিরলসভাবে কাজ করবে। এতে এফবিসিসিআই’র স্লোগান হবে ‘স্মার্ট এফবিসিসিআই ফর স্মার্ট অর্থনীতি’।”
এ সময় বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ডলার সংকটে বিপর্যস্ত বন্ধ শিল্পকারখাগুলো চালু করতে জরুরিভিত্তিতে বিশেষ তহবিল গঠনের আহ্বান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের ছায়াসঙ্গী হয়ে ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ন্যায্য বাজার ব্যবস্থা, উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণের অবাধ প্রবাহ, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করার জন্য সবাইকে নিবেদিত হয়ে কাজ করতে হবে।”
ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্মার্টলি পরিচালনার জন্য জাপানের জেট্রো, কোরিয়ার কুট্রা, চীনের সিসিপিআইটি এবং সম্প্রতি ভিয়েতনামের ট্রেড সেন্টারের মতো বাংলাদেশে একক পেশাজীবীভিত্তিক বিনিয়োগ-ব্যবসাবান্ধব সংস্থা স্থাপনের দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক দেশগুলোতে ফোকাল পারসন হিসেবে একজন করে ব্যবসায়ী নিয়োগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বাংলাদেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। উন্নত দেশগুলো থেকে দেওয়া প্রায় সব বাণিজ্য সুবিধা প্রত্যাহার হবে। তখন রপ্তানি বাজারে টিকে থাকতে হলে পণ্য উৎপাদন খরচ কমানো জরুরি হয়ে পড়বে।”
“সেজন্য ডব্লিউটিওর কমপ্লায়েন্সের সঙ্গে সমন্বয় করে ভ্যাট-ট্যাক্স এবং ইউটিলিটির চার্জ সমন্বয় করা, কারিগরি ও অভ্যন্তরীণ নীতি সহায়তা জরুরি।”
অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরে জসিম উদ্দিন বলেন, “বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস ও কয়লা উত্তোলন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এসএমই খাতে সর্বনিম্ন সুদহার রাখতে হবে। বিদেশি প্রকল্পে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে ডলারের সাশ্রয় করা যেতে পারে। বন্দর ও লজিস্টিসক সহায়তার উন্নতি করতে হবে।”
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “করের বোঝা কমানোর জন্য করজাল বাড়ানো দরকার। ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থা বাস্তবায়নে এনবিআরের অতিরিক্ত ক্ষমতা কমানো দরকার, তবে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।”
“এনবিআরের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এতে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে স্মার্টভাবে কর আদায় অনেক বেশি কার্যকর হবে,” ব্যবসায়ীদের এই নেতা।
অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, “দেশীয় শিল্পের বিকাশ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ অবকাঠামো উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। ফলে পরিবর্তনশীল বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে আধুনিকতার উৎকর্ষে বদলে যাবে বাংলাদেশ।”
“আমি মনে করি সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে পারব সমৃদ্ধ সুন্দর বাংলাদেশ। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে নিজেদের অবস্থান করব আরও উন্নত। সে জন্য শেখ হাসিনার সরকার, বারবার দরকার।’”
এফবিসিসিআইয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত মার্চে তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলন আয়োজন করেছিল এফবিসিসিআই। ওই সম্মেলনে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৬টি অধিবেশনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা উঠে আসে। সেগুলো একত্র করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সেই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে এফবিসিসিআই।
সম্মেলনে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশ- এর সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেছেন, স্মার্ট বাংলাদেশ সরকারের দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন পরিকল্পনা, যা বাস্তবায়নের জন্য দরকার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো। আর উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ বাড়াতে হবে। এজন্য সরকারকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তিনি বলেন, “বিদ্যুত খাতে অলস সক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হচ্ছে। জ্বালানি আমদানি করতে না পারার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এজন্য কয়লা ও গ্যাস উত্তোলনে উদ্যোগ দরকার।”
রেলওয়ে খাত সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
“ডিজিটাল বাংলাদেশের কারণেই করোনার মতোন মহামারিতেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো ছিল।” সরকারকে কৃষিখাতের আধুনিকায়নে জোর দেওয়ারও সুপারিশ করেন তিনি।
শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাহবুবুর রহমান বলেন, “এবারের বাজেটে কর বিভাগের কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাহলে আদালতের আর প্রয়োজন কি থাকলো?”
কর বিভাগের কর্মকর্তাদের কোনোভাবেই বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হবে না। বরং কর খাতের ব্যাপক সংস্কার দরকার।”
ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে আট লেনের পরিবর্তে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব করেন মাহবুবুর রহমান।
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, “আপনার কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার বিকল্প, শুধু শেখ হাসিনা”
তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা এখন বিশ্বে একটি ব্র্যান্ড। সারা বিশ্বকে তিনি বাংলাদেশের প্রতি আকর্ষণ করতে পারেন।”
এসময় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগের কথা স্মরণ করে আকবর সোবহান বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে।”
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, “ব্যবসায়ীরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়। শান্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করতে চায়। কিন্তু ইদানীং প্রতিদিন পদযাত্রা বা অন্যান্য কর্মসূচির নামে জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে। এটা কোনো রাজনীতি নয়। গণতন্ত্র মানে এই নয় যে, যার যা খুশি সে তাই করবে।”
"সারা দেশের ব্যবসায়ীদের ম্যান্ডেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেয়ে গেছেন। ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার সরকারের পাশে আছে, থাকবে। সংবিধান অনুযায়ী, আগামী নির্বাচন সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে হবে। সংবিধানের বাইরে কিছু হবে না।"
আকবর সোবহান বলেন, দেশে কর দিতে সক্ষম ৪ কোটি মানুষ আছে। কিন্তু, কর দেয় ৩০ লাখ লোক। কর সংগ্রহ আরও বাড়াতে হবে।
বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা-মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, “সাড়ে ১৪ বছর আগে (যুক্তরাষ্ট্রে) বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার সময় সেখানে স্লোগান ছিল 'চেঞ্জ উই নিড'। একই সময়ে গোলার্ধের অন্যপ্রান্তে আমাদের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্লোগান ছিল 'দিন বদলের সনদ'। দিন এখন বদলে গেছে।”
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আমাদের আপামর জনসাধারণের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সবকিছু দিয়েছেন। বললেই কি আমরা উনাকে পরিবর্তন করে ফেলব? গত ১৪ বছরে দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা আগে হয়নি। এখন অনেক প্রজেক্ট অর্ধেক সম্পন্ন হয়ে আছে। সরকার পরিবর্তন হলে সব প্রজেক্ট বন্ধ হবে।”
নজরুল ইসলাম মজুমদারও বর্তমান সরকারকে আবারো ক্ষমতায় চেয়ে তার বক্তব্য শেষ করেন।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফআইসিসিআই) সভাপতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় বলেন, “বাংলাদেশ হচ্ছে সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের গল্প। এক সময় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কোম্পানির বেশিরভাগ সিইও ছিলেন বিদেশি। এখন হাতেগোনা কয়েকজন বিদেশি সিইও রয়েছেন। এর কারণ বাংলাদেশের সক্ষমতায় উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে সক্ষমতা বেড়েছে।”
তিনি বলেন, “দেড় যুগের ধারাবাহিক উন্নতির পরে এবার কিছু চ্যালেঞ্জ এসেছে। সেটা বাংলাদেশের জন্য ইউনিক না। সবাই মিলে কাজ করতে হবে। যেটা দেশের জন্য ভালো, সবার জন্য ভালো- তা নিয়ে সবাই মিলে কাজ করলে দেশ এগোবেই।”
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কিছু সংস্কার দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কমেন্ট