এক দশকে জিডিপি বেড়েছে ছয় গুণ, রাজস্ব দ্বিগুণও হয়নি
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।
নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়েই চলেছে; প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারাও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু অর্থনীতি বড় হওয়ার পুরো সুফল ঘরে তুলতে পারছে না সরকারের শুল্ক–কর আদায়কারী সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড– এনবিআর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য বলছে, দশ বছর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বা অর্থনীতির আকার ছিল ৭ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। ৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে সোয়া ৩ লাখ কোটি টাকা হয়েছে।
এই হিসাব বলছে, এক দশকে জিডিপি বেড়েছে ছয় গুণ। আর রাজস্ব দ্বিগুণও হয়নি।
অর্থনীতির বড় হওয়ার এই সুফল এনবিআর ঘরে তুলতে পারেনি বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। আর এটিই বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বল দিক বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
এনবিআর গত বৃহস্পতিবার রাজস্ব আদায়ের সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি।
অর্থাৎ গত অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি শুল্ক-কর আদায় হয়েছে দেশে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ লাখ ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
এতে দেখা যাচ্ছে, গেলো অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমে আগের অর্থবছরের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। শুধু তাই নয়, এই প্রবৃদ্ধি এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
তবে, এটি রাজস্ব বোর্ডের সাময়িক হিসাব, যা চূড়ান্ত হিসাবে কিছু কমবেশি হতে পারে।
এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষ করে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে পরের পাঁচ বছর শুল্ক-কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি পৌনে ১১ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে ছিল।
তবে কোভিড মহামারি শুরুর প্রথম বছরে লকডাউনের কারণে তিন মাসের মতো সবকিছু বন্ধ থাকায় রাজস্ব আদায় আগের অর্থবছরের চেয়ে কমে গিয়েছিল।
এনবিআরের প্রবৃদ্ধি এত কমল যখন রাজস্ব আদায় বাড়াতে সবচেয়ে চাপে আছে সংস্থাটি। একদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চাপ, অন্যদিকে সরকারের বাজেটে খরচ বৃদ্ধির জোগান বাড়াতে ধারাবাহিক চাপ। প্রতিবছরই এনবিআরকে বাড়তি রাজস্ব জোগানের জন্য বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু বাস্তবে এত প্রবৃদ্ধি তো হয়ইনি, উল্টো এক দশকের মধ্যে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে। লক্ষ্য থেকে ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফ রাজস্ব আদায়ের জন্য ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি লক্ষ্য দিয়েছিল; সেটিও অর্জিত হয়নি। এর মধ্যে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিয়মিত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে জিডিপির প্রায় আধা শতাংশের সমান বাড়তি শুল্ক-কর আদায়ের শর্ত আরোপ করেছে আইএমএফ।
এনবিআরের সাময়িক হিসাবে দেখা গেছে, আয়কর ও শুল্ক আদায়ে প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে নেমেছে। আয়কর ও ভ্রমণ কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা, এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ।
শুল্ক খাতে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯১ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। এতে প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
তবে ভালো করেছে ভ্যাট খাত। এ খাতে প্রবৃদ্ধি মন্দের ভালো। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ২৭ শতাংশ। যদিও ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আমরা আগেই বলেছিলাম, এবার রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ; তাই হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কোভিডের এক বছর ছাড়া সব অর্থবছরেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও মোটামুটি ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। এবার সেই প্রবৃদ্ধিও ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।”
তিনি বলেন, এনবিআরকে প্রতিবছর তার সক্ষমতার চেয়ে বেশি লক্ষ্য চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যমান করকাঠামো দিয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ এবং বিশাল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বড় লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করতে গিয়ে যারা কর দেয়, তাদের ওপর বাড়তি কর আদায়ের কৌশল নেয় এনবিআর।
“কোভিডের সময় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর রাজস্ব আদায়ে বড় উল্লম্ফন হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এনবিআর এখন রেসের পুরোনো ঘোড়ার মতো হয়ে গেছে। এখন শক্তিশালী ঘোড়া দরকার। বড় ধরনের সংস্কার করেই এনবিআরকে শক্তিশালী ঘোড়ায় পরিণত করতে হবে,” বলেন আহসান মনসুর।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে ডলার–সংকটের কারণে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে আমদানি কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে আয়কর ও ভ্যাট আদায়ে।
জিডিপির সঙ্গে তালমিলিয়ে রাজস্ব আদায় না বাড়ায় কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে একেবারে নাজুক অবস্থানে চলে এসেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত কম হওয়ার কারণ, এ দেশে বিপুল পরিমাণ কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া জটিল করব্যবস্থা, দুর্বল কর প্রশাসন—এসব কারণে কর আদায় কম হয়। ফলে সরকারকে বিপুল অর্থ ঋণ করতে হয়।
তবে আহসান মনসুর বলেন, সঠিকভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে দেশে কর-জিডিপি অনুপাত এখন ৮ শতাংশের কম।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে ২০১৬ থেকে ২০২০- এই পাঁচ বছরের কর-জিডিপির অনুপাত গড়ে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ (২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে করা হিসাবে) দেখানো হয়।
পূর্বের হিসাবে (২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে করা হিসাবে) যা ১০ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশে ‘বিশ্বের সবচেয়ে কম’ কর-জিডিপির অনুপাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল দুই সংস্থা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এই অনুপাত বাড়াতে সরকারকে বিভিন্ন সময়ে নানা পরামর্শ দিয়েছে; ঋণের বিপরীতে শর্ত হিসেবেও যুক্ত করে দিয়েছে এটি বাড়ানোর। সরকারও নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এই অনুপাত বাড়েনি; উল্টো কমছেই।
গত ৩০ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ অনুমোদন করেছে, তাতে শর্ত হিসেবে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর করার তাগিদ দিয়েছে। আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ কোটি ডলার ইতিমধ্যে পেয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে না পারলে ঋণের বাকি কিস্তি আটকে যেতে পারে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন দীর্ঘ সময় আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান এইচ মনসুর।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল গড়ে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ বিশ্বের উদীয়মান দেশ ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ হার বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি অর্থাৎ ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
এমনকি সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলোর কর-জিডিপি হারও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এই পাঁচ বছরের গড় কর-জিডিপি অনুপাত নেপালের ২৩ দশমিক ৩, ভারতের ২০ দশমিক ৩, পাকিস্তানের ১৫ দশমিক ২ এবং শ্রীলঙ্কার ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “দেশের কর-জিডিপি হার লজ্জাজনক ও বিব্রতকর। কর-জিডিপি অনুপাত কম হওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধনীর কাছ থেকে আয়কর না নেওয়া।”
কমেন্ট