পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ তৈরি না হলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ‘বোঝা’ হয়ে উঠতে পারে
পরিবর্তনশীল পরিবেশে বাংলাদেশের জন্য টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিষয়ক দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার-আইজিসি। ছবি: সংগৃহীত
দেশে বর্তমানে ১১ কোটি ১৪ লাখ কর্মক্ষম মানুষ রয়েছেন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশ। তাদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও তাদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করা প্রয়োজন। তা না হলে বাংলাদেশ বর্তমানে যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতি কাজে লাগানোর যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা দায় বা ‘বোঝা’ হয়ে উঠতে পারে।
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে পরিবর্তনশীল পরিবেশে বাংলাদেশের জন্য টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিষয়ে আয়োজিত এক সম্মেলনে এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞেরা।
দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার-আইজিসি।
সম্মেলনের প্রথম দিন বুধবার বক্তারা ২০৪১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থনীতি বহুমুখীকরণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সম্মেলনের সূচনা বক্তব্যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম দুই খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। কিন্তু বিগত দুই দশকে তৈরি পোশাকের সমপর্যায়ের অন্য কোনো রপ্তানি খাত তৈরি করতে পারিনি।”
“একইভাবে বিদেশে দক্ষ লোক পাঠাতে পারছি না বলে প্রবাসী আয়ও কম আসছে। এ ছাড়া কর–জিডিপি অনুপাত হ্রাস, ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা, অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় ইত্যাদি বিষয় আমাদের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা কমাচ্ছে। সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতিকে টেকসই বলা যায় না।”
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সমন্বিত বিনিয়োগ ও বাণিজ্যনীতি নেই। সরকারের বিভিন্ন নীতি ও সুশাসনের অভাবের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত গতিতে হচ্ছে না। বিশেষ করে সেবা রপ্তানি ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে আমাদের ঘাটতি রয়েছে।”
উন্নত দেশে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে ২০৩১ সাল নাগাদ প্রতিবছর ১৯ লাখ ৩০ হাজার কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে, এ তথ্য দিয়ে মাশরুর রিয়াজ বলেন, বিপুল এ কর্মসংস্থানের চাহিদা ডিজিটাল ও পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি—এই দুই খাত থেকে মেটানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে বেসরকারি খাত।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার জ্যেষ্ঠ গবেষক মোহাম্মদ ইউনূস বলেন, রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে স্থানীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতায়নের পরামর্শ দেন তিনি।
আইজিসির নির্বাহী পরিচালক জনাথন লিপের সঞ্চালনায় এ অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী সদস্য মোহসিনা ইয়াসমিন এবং যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসের বাংলাদেশ কার্যালয়ের ডেপুটি ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর ডানকান ওভারফিল্ড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সঞ্চালনায় দ্বিতীয় অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয় অভ্যন্তরীণ সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের বিষয়ে।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক। তিনি বলেন, “দেশে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি ব্যয় অনেক কম। এ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বৈষম্য বৃদ্ধি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পথে বড় বাধা। সরকার প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে অনেক ক্ষেত্রে করছাড়ের সুবিধা দিয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়ন কাজের জন্য পুরোপুরি নির্ভর করেছে দেশি–বিদেশি ঋণের ওপর। এসব কারণে বৈষম্য বাড়ছে।”
রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ। তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আর্থ–রাজনৈতিক চাপ কমাতে হবে।
এই অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ, বর্তমান সদস্য মো. ইকবাল হোসেন ও আইজিসির অর্থনীতিবিদ অলিভার হারম্যান।
কমেন্ট