ভারতের নিষেধাজ্ঞায় চাল নিয়ে উদ্বেগ, দাম বাড়ছে
ভারতের এ পদক্ষেপের পর বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে চাল রপ্তানিতে দাম বাড়ানো হয়েছে।
রাশিয়া নবায়ন না করার কারণে কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে নিরাপদে শস্য পরিবহনের জন্য করা চুক্তি (শস্যচুক্তি) গত ১৭ জুলাই বাতিল হয়ে গেছে। এ কারণে বিশ্ববাজারে গম ও ভুট্টার দাম বেড়েছে।
অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির কারণ দেখিয়ে হঠাৎ করে গত বৃহস্পতিবার বাসমতী ছাড়া অন্য সব ধরনের চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, পরপর এই দুই ঘটনা বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ভারতে চলতি বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে গত এক মাসে দেশের অভ্যন্তরে খুচরা বাজারে চালের দাম ৩ শতাংশ বেড়েছে—এমন কারণ দেখিয়ে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চাল রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ভারত সরকার, যা ২০ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্ববাজারে বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত। আন্তর্জাতিক বাজারে এককভাবে ৪০ শতাংশের বেশি চাল রপ্তানি করে দেশটি। এর মধ্যে বাসমতী ছাড়া অন্যান্য সাদা চাল রপ্তানি হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। বাকিটা উচ্চমানের বাসমতী চাল।
ভারতের খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত এক বছরে দেশটিতে চালের দাম ১১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু গত মাসেই চালের দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে ভারতীয় চালের আন্তর্জাতিক বিক্রি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। এসব কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের সরবরাহ স্থিতিশীল ও মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে বাসমতী ছাড়া অন্য সব চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত সরকার।
ভারতের এ পদক্ষেপের পর বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে চাল রপ্তানিতে দাম বাড়ানো হয়েছে। যেমন ভারতের ৫ শতাংশ ভাঙা পারবয়েলড জাতের প্রতি মেট্রিক টন চালের দাম চলতি সপ্তাহে ৪২১ থেকে ৪২৮ ডলারের মধ্যে ছিল। গত শুক্রবার তা ছিল ৪২৪ দশমিক ৫০ ডলার। দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, এই দাম গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে এই দুটি দেশের ৫ শতাংশ ভাঙা চালের দামও বেড়েছে। এর মধ্যে থাইল্যান্ডের রপ্তানি করা চালের দাম গত দুই বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ বেড়েছে। আর ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার আগে থেকেই ভিয়েতনামে এ ধরনের চাল বেশি দামে বিক্রি হচ্ছিল।
চাল আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাজারে নতুন কোনো পরিবর্তন না এলে সামনের দিনগুলোতে চালের দাম আরও বাড়তে পারে।
এদিকে বিশ্বের অন্যতম দুই শস্য উৎপাদনকারী দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়ার শস্য মূলত কৃষ্ণসাগর দিয়ে পরিবহন করা হয়। কিন্তু ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর এ পথে শস্য পরিবহন বাধাপ্রাপ্ত হয়, যার প্রভাব পড়ে বৈশ্বিক বাজারে।
সমস্যা সমাধানে গত বছরের জুলাইয়ে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেন ‘কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি’তে সই করে। তবে সর্বশেষ গত সপ্তাহে রাশিয়া চুক্তিটি আর নবায়ন না করায় চুক্তিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়। এ কারণে আবার গম ও ভুট্টার দাম বাড়তে শুরু করেছে।
বেশি দামে চাল আমদানি করতে হবে বাংলাদেশকে
খাদ্যের মজুত বাড়াতে বাংলাদেশ যখন চাল আমদানির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে, তখনই চাল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা দিল ভারত। এখন বাংলাদেশকে বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে; এতে খরচ বেশি হবে।
গত ১২ জুুলাই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক বিষয়–সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ১১ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে পাঁচ লাখ টন চাল ও ছয় লাখ টন গম।
সরকার থেকে সরকার (জি–টু–জি) পর্যায়ে তিন লাখ টন চাল, আর আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে দুই লাখ টন চাল কেনা হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় এই চাল আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র জমা দিতে বলেছে।
বাংলাদেশে অবশ্য খাদ্য নিয়ে এখন খুব একটা চিন্তা নেই। গত আমন ও বেরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামগুলোতে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও পর্যাপ্ত চাল মজুত রয়েছে। আপতকালীন সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে খাদ্যশস্য আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত সরকারি গুদামগুলোতে ১৯ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৯ মেট্রিক টন খাদ্য মজুত আছে। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৮ হাজার ২৩৩ টন চাল, ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৬৭ টন গম এবং ১ লাখ ২১ হাজার ৯২ টন ধান।
বর্তমান পেক্ষাপটে দেশে সরকারি গুদামে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন খাদ্য মজুত থাকলেই যথেস্ট বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এখন প্রচুর চাল মজুদ আছে। এক বছর খুব একটা চিন্তা নেই। টিসিবি কার্ডের মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রিসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনীর বিভিন্ন কর্মসূচীর আওতায় যে সব কর্মসূচী চলমান আছে, সেগুলোর জন্য আগে থেকে মজুত বাড়াতে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার।”
“এখন বিশ্ব পেক্ষাপটের কারণে দাম বেশি পড়বে। তারপরও আমদানি করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। কেননা, রাশিয়া শস্যচুক্তি নবায়ন না করায় এবং ভারত চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিয়ে নতুন সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে।”
“আমাদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন,” বলেন জাহাঙ্গীর আলম।
কমেন্ট