বাংলাদেশে কেন কমছে না মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, কানাডা, ব্রাজিলসহ ছোট-বড় সব দেশেই স্পর্শকাতর এই সূচকটি সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও ১০ মতাংশের কাছকাছি অবস্থান করছে। কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির উদ্বেগজনক সূচক হচ্ছে এখন মূল্যস্ফীতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নীতি সুদহার বাড়িয়ে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে ভোক্তার চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পেরেছে।
গত বছরের মার্চে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ে প্রায় ৯ শতাংশে উঠেছিল; যা ছিল ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্তমানে দেশটির মূল্যস্ফীতি মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, চীন, ভারত, কানাডা, ব্রাজিলসহ ছোট-বড় সব দেশেই স্পর্শকাতর এই সূচকটি সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও ১০ মতাংশের কাছকাছি অবস্থান করছে। কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি অন্য দেশেগুলোর মতো কেনো কমছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় অবশ্য এর কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হারে নিয়ন্ত্রণ আসছে না। বরং তা বেড়ে যাচ্ছে। এ দুই কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতিতে বাড়তি চাপের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশের ঘর থেকে বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে।
এতে চাপ বাড়ার নেপথ্যে আরও রয়েছে-বৈশ্বিক অস্থিরতায় পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়া, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি এবং দেশের বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাবে অন্যসব পণ্যেরও দাম বেড়েছে। এসব মিলে চাপ বেড়েছে মূল্যস্ফীতিতে।
সরকারি হিসাবে সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্টভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি নিয়ে শেষ হয়েছে অর্থবছর। যা বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি।
আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) গড় মূল্যস্ফীতির হয়েছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বাজারের যে অবস্থা তাতে এই আশা যে পূরণ হবে না, তা অনেক আগেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। বর্তমান বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে। ১ জুন বাজেট ঘোষণার পর থেকেই মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে মূল্যস্ফীতির হার সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছরের আগস্টে এ হার ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠার পর থেকে আবার কমতে শুরু করে। সেপ্টেম্বরে তা ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ হার ৮ শতাংশের ঘরে। কিন্তু ৯ শতাংশের কাছাকাছি ছিল।
মার্চ থেকে এ হার আবার বাড়তে শুরু করে। ওই মাসে বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে ওঠে। এপ্রিলে সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নামে। মে মাসে তা বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান নেয়; অর্থাৎ ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে ওঠে। জুনে সামান্য কমে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে নামে।
অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি-এই পাঁচ মাস ৮ শতাংশের ঘরে থাকার পর মার্চ থেকে জুন-এই চার মাস ৯ শতাংশের ঘরে উঠেছে। আলোচ্য সময়ে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত দুই খাতেই এ হার বেড়েছে।
গত বছরের মার্চ থেকে ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতি রয়েছে। এখনো বাড়ছে। এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ। এতে বেড়ে যাচ্ছে আমদানি খরচ। একই সঙ্গে দেশের বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ দুইয়ে মিলে মূল্যস্ফীতির হারে বাড়তি চাপ পড়েছে।
আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ১ ডলারের জন্য এখন ১০৯ টাকা খরচ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার কিনতে গেলেও এখন এই একই দর দিতে হয়। এতদিন রিজার্ভ থেকে কম দামে ডলার বিক্রি করা হলেও ১ জুলাই থেকে আন্তঃব্যাংক দরেই ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দুই দেশের মধ্যে শস্য পরিবহণ চুক্তি হয়েছিল। এর মেয়াদ গত ১৭ জুলাই শেষ হয়েছে। এটি নতুন করে আর বাড়েনি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গম, সয়াবিন তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বৈশ্বিকভাবে চালের উৎপাদন কম হওয়ায় এর দামও আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে।
ইতোমধ্যে ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ চাল আমদানি কম করলেও গম, সয়াবিন তেল এগুলোর প্রায় সবটাই আমদানিনির্ভর। ফলে এগুলোর দাম বেড়ে ডলার বাজারে সংকট আরও প্রকট করে তুলতে পারে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিতে আরও চাপ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মূল্যস্ফীতির হার কমা-বাড়ার সঙ্গে বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের কারণ জড়িত। তবে বাংলাদেশে মূলত পণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাবে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার কমছে না বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “আশার কথা হচ্ছে, গত কয়েক মৌসুম আমাদের বোরো-আমনের ভালো ফলন হয়েছে। সে কারণেই আমরা বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। গত এক-দেড় বছর চাল আমদানি করতে হয়নি। একবার ভেবে দেখুন, ডলার সংকটের এই সময়ে যদি চাল আমদানি করতে হতো, তাহলে অবস্থা কেমন হতো। মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াত?”
তিনি বলেন, “বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে শিগগিরই মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা থেকে রেহাই মিলছে না। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শস্যচুক্তি বাতিল হওয়ায় এখন নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। এর প্রভাবে বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হবে, পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। তখন মূল্যস্ফীতিতে আরও চাপ বাড়বে।”
“মূল্যস্ফীতি বিদেশ থেকে আমদানি করা—এ কথা বলে আর কত দিন পার পাওয়া যাবে। পাশের দেশ ভারত, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল, তারা কমিয়ে এনেছে। অন্য দেশ পারলে আমরা কেনো পারছি না,” প্রশ্ন করেন আহসান মনসুর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে একটি বড় কারণ থাকে বাজারে টাকার প্রবাহ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে টাকার জোগান বৃদ্ধি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে টাকার প্রবাহ বাড়েনি। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে সময়ে বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আগের অর্থবছরে বেড়েছিল ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী টাকার প্রবাহ বাড়েনি।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও এখনো টাকার প্রবাহ বৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে রয়েছে। ফলে এখন যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, তা টাকার প্রবাহ বৃদ্ধিজনিত কারণে নয়। ডলারের দাম বৃদ্ধি ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধিই নতুন করে মূল্যস্ফীতিতে বাড়তি চাপের সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি আগের উপসর্গগুলো যেমন- জ্বালানি ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব এখনো রয়ে গেছে।
আমদানি পণ্যের দাম বৈশ্বিকভাবে অনেক কমলেও দেশের বাজারে কমছে না, বরং বাড়ছে। যেসব পণ্যের আমদানি চাহিদার তুলনায় স্বাভাবিক রয়েছে, সেসব পণ্যের দামও বাড়ছে। আমদানি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দেশের পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপরও চাপ কমবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার প্রভাব অনেক দেশের বাজারেই পড়তে শুরু করেছে। তারা সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতির হার অনেকটাই কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তা পারেনি। বরং বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে আইএমএফের এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে ভারতে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ, এটি তারা ৪ শতাংশ নামিয়ে আনতে চায়। ইন্দোনেশিয়ার মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের বেশি। এটি তারা ৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায়। যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ। এটি তারা ২ শতাংশে নামাতে চায়। ইতালির ৮ শতাংশ, তারা ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায়। জার্মানির মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ, তারা ২ শতাংশে নামাতে চায়।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, থাইল্যান্ড খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। মালদ্বীপে ৮ থেকে কমে ৬ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। মালয়েশিয়া ৭ দশমিক ৪ থেকে ৫ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্র ১১ দশমিক ৪ থেকে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। যুক্তরাজ্যে ১৯ দশমিক ৮ থেকে কমে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। সুইডেনে ২২ দশমিক ১ থেকে কমে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। স্পেনের ১৬ দশমিক ৭ থেকে কমে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। সিঙ্গাপুরে ৮ দশমিক ১ থেকে কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। সৌদি আরবে ৪ দশমিক ৮ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে।
কমেন্ট