পাশে আছে জাপান, আগামী ৫০ বছরও থাকবে

পাশে আছে জাপান, আগামী ৫০ বছরও থাকবে

জাপানের অর্থনীতি ও বাণিজ্যমন্ত্রী ইয়াসুতোশি নিশিমুরার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট দেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জাপান সরকার এ অগ্রযাত্রায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।” ছবি; সংগৃহীত

দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বেশ চাপে থাকা অর্থনীতি এবং অভ্যন্তরীণ উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ইয়াসুতোশি নিশিমুরা ঢাকা সফর করছেন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জাপান-এটা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপানের অবদান সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। 

এই যে রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও মেট্টোরেল ছুঁটছে; কিছুদিনের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত ছুঁটবে-এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে জাপান সরকার। শুধু এই মেট্টোরেল নয়, ৫০ বছরে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিটি ধাপে অবদান রেখে চলেছে জাপান। 

আর সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পাশে থাকতে আগামী ৫০ বছরের পরিকল্পনা সাজাতে বলেছেন জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ইয়াসুতোশি নিশিমুরা।

রোববার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-জাপান ইকোনমিক রিলেশন ফর দ্য নেক্সট ফিফটি ইয়ার্স’ শীর্ষক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছেন, “গত ৫০ বছরে জাপান বাংলাদেশের পথ চলার আলোকে আমাদের আগামী ৫০ বছরের পরিকল্পনা ঠিক করা দরকার। বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এই বাইরে রয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মতো অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ। এই ক্ষেত্রে জাপানের বিনিয়োগে বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য অবকাঠামোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।” 

অতীতের বাণিজ্যের পাশাপাশি বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব, চলমান বিনিয়োগ এবং ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেন তিনি। 

নিশিমুরা বলেন, আজকের বাংলাদেশ আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগতি লাভ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্ব ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে জাপানি কোম্পানিগুলোরও অবদান রয়েছে। 

তিনি বাংলাদেশ সরকারকে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন। 

জাপান ও বাংলাদেশের শত বছরের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস টেনে ইয়াসুতোশি বলেন, জাপানের কোবে শহরে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত কয়জুমি কোম্পানি শতবছর আগে এ অঞ্চলের পাট নিয়ে পাটকলের ব্যবসা শুরু করে। এটি এখন জাপানের খুবই উৎপাদনশীল একটি কোম্পানি।

“স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে সহায়তা ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করে আসছে জাপান। বিশেষ করে যমুনা ব্রিজ, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আজকের এ ভেন্যু সোনারগাঁও হোটেল।” 

দেশটির বিনিয়োগের বর্ণনা দিয়ে ইয়াসুতোশি বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাপান প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩০০ জাপানিজ বিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগ করে আসছে। আজকের এ সোনারগাঁও হোটেলও জাপানিজ ওডিএ ঋণের মাধ্যমে নির্মিত। তাই হোটেলটি জাপান বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের স্মৃতি বহন করছে।” 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ আরও ত্বরান্বিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২২ সালে বাংলাদেশে জাপানের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ; প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে স্পেশাল ইকনোমিক জোন প্রতিষ্ঠিত হয়। 

বাংলাদেশের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিকল্পনাতেও জাপানের অংশীদার হওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে বিবেচিত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৫ থেকে ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। এখন ২০২৬ সালে এলডিসি পর্যায় অতিক্রম করার সময়সীমা ঠিক করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশটি উন্নত দেশের মর্যাদায় যাওয়ার লক্ষ্যও ঠিক করেছে। 

শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের বিষয়ে সরকারের সঙ্গেও বিভিন্ন কাজ চলছে জানিয়ে জাপানের অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারি বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন সংক্রান্ত কাজ করতে একটি পথরেখা তৈরি করেছি। দুই দেশের মধ্যে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টিগুলো নিয়েও আমরা আলোচনা করছি। এগুলো বাংলাদেশে বিভিন্ন জাপানি কোম্পানির শাখা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। 

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, জাপান-বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিতে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির (ইপিএ) কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে জাপানে এ সংক্রান্ত প্রথম রাউন্ড আলোচনা হয়েছে এবং আগামী ২৫-২৬ জুলাই ঢাকায় দ্বিতীয় রাউন্ড আলোচনা হবে। খুব শিগগির এ চুক্তি করার বিষয়ে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। 

অনুষ্ঠানের পর জাপানের অর্থনীতি ও বাণিজ্যমন্ত্রী ইয়াসুতোশি নিশিমুরার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট দেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জাপান সরকার এ অগ্রযাত্রায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।”

“জাপান দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশ হিসেবে পাশে আছে। তারা আমাদের দেশের বড় বড় প্রজেক্টে বিনিয়োগ করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়েছে।”  

উভয়দেশের ব্যবসায়ীদের মাঝে যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় খাত অনুসন্ধান করার ওপর জাপানের অর্থনীতি ও বাণিজ্যমন্ত্রী গুরুত্বারোপ করেছেন বলে জানান টিপু মুনশি।  

উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপানের পথচলা

বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপানের পথচলা শুরু হয় ১৯৭৩ সালের মার্চে। এই মার্চে ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে জাপান একটি ম্যাগাজিন তৈরি করেছে। সেই ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল পর্যন্ত জাপান বাংলাদেশকে ৯৬ হাজার ৪৬ মিলিয়ন ইয়েনের কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ওডিএ) কর্মসূচির আওতায় দেশটি দিয়েছে ২,৩৯৫.২৮২ বিলিয়ন ইয়েন। এই সময়ে অনুদান সাহায্য এসেছে ১৩৯,০৮৪ মিলিয়ন ইয়েন। 

এই ৫০ বছরে প্রশিক্ষণার্থী এবং বিদেশি শিক্ষার্থী এসেছেন ১৩ হাজার ৮৬৬ জন। দেশটির বিদেশি সহযোগিতা সেচ্ছাসেবী এসেছেন এক হাজার ২৮৪ জন। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) থেকে বিশেষজ্ঞ এসেছেন চার হাজার ৯২১ জন। 

যে সব খাতে কাজ করছে জাপান

বাংলাদেশে অন্তত নয়টি খাতে কাজ করছে জাপান। এক. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, দুই. পরিবহন, তিন. নগর উন্নয়ন, চার. সুশাসন, পাঁচ. স্বাস্থ্য, ছয়. শিক্ষা, সাত. কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, আট. দুর্যোগ প্রতিরোধ ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ। 

এছাড়া বেসরকারি খাতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় ওয়ান-স্টপ সেবা প্রচলনের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশল পরীক্ষার (আইটিইই) প্রচলন করতে সহায়তা দিয়েছে দেশটি। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি: জাইকার দাবি, তারা বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে ২ হাজার ৪৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশের মোট সক্ষমতার ১২ শতাংশ। এছাড়া ২৫ হাজার কিলোমিটারের বেশি বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন নির্মাণ ও সংস্কার করেছে সংস্থাটি। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য ১০৮টি সাবস্টেশন নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেছে তারা।

পরিবহণ: ১৩৪টি সেতু তৈরিতে সহায়তা করেছে জাইকা। যার মধ্যে ছয়টি সেতুর দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটারের বেশি (যেমন যমুনা, পাকসী, রূপসা, গোমতী, মেঘনা ও কালনা সেতু)। তিনটি ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা এমআরটি প্রকল্প (লাইন ৬. লাইন ১, এবং লাইন ৫ নর্থ) তৈরি করছে সংস্থাটি। যার মাধ্যমে ২০ লাখ যাত্রী দৈনিক যাতায়াত করতে পারবে। এমআরটি লাইন ৬ শেষ হলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াতের সময় ১০৫ মিনিট থেকে কমে ৩৬ মিনিট হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিমানবন্দর অবকাঠামো নির্মাণ, যেখানে দৈনিক মোট ১৪ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করবে। 

নগর উন্নয়ন: ঢাকার পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতিতে জাপান সহায়তা দিয়েছে। 

দুর্যোগ প্রতিরোধ/জলবায়ু পরিবর্তন: প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কমাতে সারাদেশে পাঁচটি আবহাওয়া রাডার স্থাপনে সহায়তা দিয়েছে জাইকা। ১১৭টি উচ্চ মানসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে তারা। এছাড়া জাইকার সহায়তায় বন্যা প্রতিরোধে ২৪০ কিলোমিটার নদীর বাঁধ নির্মিত হয়েছে। 

কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন: ৪৮৯ জন বিশেষজ্ঞের কারিগরি নির্দেশনার মাধ্যমে ধান উৎপাদনের হার বাড়াতে সাহায্য করেছে জাপান এবং অংশগ্রহণমূলক গ্রামীণ উন্নয়নের (লিংক মডেল) প্রচলন করে ২১৫টি উপজেলায় কাজ করেছে দেশটি। 

শিক্ষা: জাপানে প্রস্তুতকৃত ‘লেসন স্টাডি’  ছড়িয়ে দিতে নানামুখী পদক্ষেপের কথা কিছুদিন আগেও গণমাধ্যমে এসেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তাদের সহায়তায় অনুসন্ধানভিত্তিক ও সমস্যা সমাধানভিত্তিক পাঠদান উন্নয়নে পাঠ্যবই পরিমার্জন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার বিদ্যালয় পরিমার্জিত পাঠ্যবই পেয়েছে। 

স্বাস্থ্য: জাপান ২০৫ জন জাপান ওভারসিস কোঅপারেশন ভলানটার্স (জেওসিভি)  পাঠিয়ে পোলিও এবং ফিল্যারিয়া নির্মূলে সাহায্য করেছে। এছাড়া ২.৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য ৪১৭টি কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে জাইকা। ‘নরসিংদী মডেল’ দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হয়েছে। 

সুশাসন: ৪৯২টি উপজেলায় অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে ছোট আকারের অবকাঠামোর প্রচলন করেছে দেশটি। ৬৪টি জেলায় মৎস্য, পশুসম্পদ, কৃষি সেচ, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ এবং শিক্ষার মতো বিভিন্ন সেক্টরে ২৮০০টিরও বেশি অংশগ্রহণমূলক প্রকল্পে কাজ করেছে দেশটি।

ব্যবসায়ীরা নতুন আশায় 

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত হলে জাপানভিত্তিক কোম্পানি ও যৌথ উদ্যোগের প্রত্যাশায় নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তাদের আশা, এই অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ইতিহাস নতুন মাত্রা পাবে। 

জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি তারেক রাফি ভুঁইয়া এ বিষয়ে এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ‘‘নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ইকনোমিক জোন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ডিসেম্বরের ৬ তারিখ উদ্বোধন করেছেন। জাপানি প্রতিষ্ঠান এর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকায় তাদের অনেক কোম্পানি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট করার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে। জাপানের সঙ্গে ব্যবসায়িক খাতে এটা নতুন মাত্রা যোগ করবে।’’ 

জেবিসিসিআই’র এই সদস্য বলেন, ‘‘বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগের অবস্থা এখন বেশ ভালো। তাদের অনেকগুলো প্রজেক্ট বাংলাদেশে চলছে। প্রজেক্টগুলো ভালো করায় অনেক কোম্পানি বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশের জিডিপি এখন ভারতের চেয়ে ভালো আর সার্বিকভাবে ভিয়েতনামের চেয়েও বড় হয়েছে। তাই বাংলাদেশের মার্কেট ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। একারণে জাপানের অনেক কনজিউমার এবং সার্ভিস কোম্পানি বিনিয়োগ করছে।’’

যেসব প্রকল্প নিয়ে চিন্তা 

গত জানুয়ারির শেষ দিকে জাইকা একটি প্রতিবেদনে জানায়, তাদের অর্থায়ন করা ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে ১৫টির বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। জাইকার বাংলাদেশ অফিস জানুয়ারির ২২ তারিখ ঢাকাকে বিষয়টি অবহিত করে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদনে দেরি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে হিসাব খুলতে দেরি হওয়ার কারণে ৯ মাসেও কোনো উন্নতি হয়নি আরবান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সিটি গভর্নেন্স প্রজেক্টের। এ প্রকল্পের জন্য জাইকা ২০২২ অর্থবছর (২০২২ এপ্রিল- ২০২৩ মার্চ) মেয়াদে ১০২ কোটি ইয়েন (৮২ কোটি টাকার বেশি) বরাদ্দ করেছে। একইভাবে হেলথ সার্ভিসেস স্টেনথেনিং প্রজেক্ট এবং ফুড ভ্যালু চেইন ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টে অগ্রগতি না হাওয়ার কথা জানায় দেশটি। 

কাজে অগ্রগতি না হওয়ার জন্য জাইকা তাদের প্রতিবেদনে কিছু কারণের কথা উল্লেখ করেছিল: ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, অনুমোদন প্রক্রিয়া, বিডিং এবং রিবিডিং নথি প্রস্তুত করা। ক্রয়ে ধীরগতি এবং কিছু সিভিল কাজের জন্যেও অনেক প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করে তারা।

 

মেগাপ্রকল্পগুলোর অবস্থা 

নির্মাণাধীন বাংলাদেশের আরেকটি বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ প্রায় শেষের দিকে; সমুদ্র ঘেঁষা মাতারবাড়ীর এ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে চলতি বছরেই। 

সাত বছর আগে কক্সবাজারের সাগর উপকূলের ইউনিয়ন মাতারবাড়ীতে জাপানি অর্থায়নে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার পাশাপাশি কাজ শুরু হয় কয়লা খালাসে বন্দরের অবকাঠামো ও জেটি নির্মাণের কাজও। 

প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক এআরএইচ ডটকমকে জানান, আগামী ডিসেম্বরেই জাতীয় গ্রিডে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ করার লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগেই এ কেন্দ্রের কাজ উদ্বোধন করবেন। 

তিনি বলেন, “আমাদের যেটা (প্রথম ইউনিট) ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে করার কথা, সেটা আমরা আশা করি ডিসেম্বরেই পুরোদমে চালু করতে পারব। আর দ্বিতীয়টা আমরা চালু করার চিন্তা করতেছি নেক্সট জুলাই। 

“এখানে প্রথমটি থেকে ৬০০ মেগাওয়াট এবং দ্বিতীয়টা থেকেও ৬০০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। তবে প্রতি ৬০০ থেকে আদারস খরচ হিসেবে ৬.৮ শতাংশ বিদ্যুৎ চলে যাবে, বাকিটা যুক্ত হবে।" 

৫১ হাজার সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রকল্পের হালনাদাগ তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে জেটি ও ভৌত অবকাঠামোর কাজ ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে, সার্বিক ভৌত অবকাঠামোর কাজ হয়েছে ৯০ শতাংশ। 

শাহজালালে তৃতীয় টার্মিনাল: পুরোদমে এগিয়ে চলছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ কাজ। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী জানিয়েছেন, এ বছরের অক্টোবরেই শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হবে। 

২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন হয়। প্রকল্পের আওতায় একটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল বিল্ডিং, রাস্তা, কার পার্কিং, কার্গো কমপ্লেক্স, পার্কিং অ্যাপ্রোনসহ আরও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। 

মেট্রো ও পাতাল রেল: ঢাকায় গণপরিবহনের যাতায়াত উন্নয়নে গৃহীত মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) প্রকল্প ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করতে চায় সরকার। মেট্রোরেল আংশিকভাবে চালু হয়েছে। ইতিমধ্যে পাতাল রেলের কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এই পাতাল মেট্রোরেল রূপগঞ্জের পীতলগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে জোয়ারসাহারার নতুনবাজারে যুক্ত হবে কমলাপুর-বিমানবন্দর মেট্রোরেল রুটের সঙ্গে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু: উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বারে যমুনা নদীর বুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। মোট ৫০টি পিলারের ওপর বসানো হবে ৪৯টি স্প্যান। ইতিমধ্যে ৩৫ নম্বর থেকে ৫০ নম্বর পিলারের কাজ শেষ করেছেন প্রকৌশলীরা।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থ ছাড় জাইকার 

বাংলাদেশকে নমনীয় শর্তের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণের প্রতিশ্রুতি ও অর্থ ছাড় করেছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। দেশটির সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (এপ্রিল–মার্চ) এ রেকর্ড হয়েছে। 

বিদায়ী এ অর্থবছরে সংস্থাটি বাংলাদেশের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে মোট ৩৩১ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন বা ২৫৮ বিলিয়ন টাকা (প্রতি ইয়েন দশমিক ৭৮ টাকা ধরে) অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যার মধ্যে ২৬১ বিলিয়ন বা ২৬ হাজার ১০০ কোটি জাপানি ইয়েন ছাড়ও করেছে জাইকা। আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ওডিএ) অংশ হিসেবে এই ঋণ সহযোগিতা দিয়েছে জাইকা। জাইকা জানিয়েছে, এর আগে গত অর্থবছরে সংস্থাটি বাংলাদেশের জন্য সর্বোচ্চ ২৬৪ বিলিয়ন বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি জাপানি ইয়েন ছাড় করেছিল। ২০২১ সালেই জাইকা বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ঋণসহায়তা দিয়েছিল। 

বাংলাদেশে জাইকার ওডিএ ঋণ প্রতিশ্রুতির সঙ্গে জড়িত ৫টি প্রকল্প হলো ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট উন্নয়ন প্রকল্প, দক্ষিণ চট্টগ্রাম আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রকল্প, মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প ও জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনের ডুয়েল গেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প। 

জাইকা জানিয়েছে, ২০২০ অর্থবছরে (এপ্রিল, ২০১৯–মার্চ, ২০২২) বাংলাদেশে ৩৭৩ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সংস্থাটি। স্থানীয় পর্যায়ে সংস্থাটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ অঙ্কের ঋণ প্রতিশ্রুতি ছিল সেটি। তবে ওই বছর করোনার কারণে বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় সংস্থাটি মাত্র ১৮০ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন ঋণ ছাড় করেছিল। 

গত এক দশকজুড়ে ওডিএ ঋণ, অনুদান ও কারিগরি সহযোগিতা স্কিমের মাধ্যমে জাইকা বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে তুলেছে। যার ফলে দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের পথ আরও সুগম হয়েছে। 

অদূর ভবিষ্যতেও জাইকা স্থানীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সঙ্গে একইভাবে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যাশা রাখে বলে সম্প্রতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে জাইকা। বাংলাদেশে জাইকার ওডিএ অর্থায়ন কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৪ সালে।

এক সপ্তাহে রিজার্ভ কমেছে ১২ কোটি ডলার পরবর্তী

এক সপ্তাহে রিজার্ভ কমেছে ১২ কোটি ডলার

কমেন্ট