বছরে ৪ হাজার কোটি টাকার কর হারাচ্ছে বাংলাদেশ
সুষ্ঠু কর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা টিজেএন জানিয়েছে, এভাবে কর ফাঁকির কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।
কর স্বর্গের কারণে বছরে ৪ হাজার ২১৮ কোটি কোটি টাকার কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
কর ফাঁকিবিরোধী আন্তর্জাতিক ফোরাম ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের ((টিজেএন) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ‘স্টেট অব ট্যাক্স জাস্টিস-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি ২৫ জুলাই, প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুনাফা বিদেশের ট্যাক্স হেভেন বা কর স্বর্গ হিসেবে পরিচিত অঞ্চলে বিনিয়োগ বা স্থানান্তর করায় বাংলাদেশ বছরে ৩৬ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের কর হারাচ্ছে।
এছাড়াও ব্যক্তিপর্যায়ে কর ফাঁকির কারণে বছরে ২ কোটি ৬ লাখ ডলার হারাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। সব মিলিয়ে দেশের বার্ষিক কর ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১০৯ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ২১৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বা করপোরেটরা প্রতি বছর ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেয়। যা দেশের কর আয়ের ১ দশমিক ৫ শতাংশ।
সুষ্ঠু কর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা টিজেএন জানিয়েছে, এভাবে কর ফাঁকির কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।
করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা কর ফাঁকি দিতে বিশ্বের বিভিন্ন অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। অর্থ দেশে রাখলে যে হারে কর দিতে হয়, বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেন বা কর স্বর্গ হিসেবে পরিচিত অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে তার চেয়ে অনেক কম হারে কর দিলেই চলে, সে কারণে ধনীরা অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশি ব্যক্তি আর করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এই কাজ করে।
কর ফাঁকির কারণে প্রতিবছর দেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার সামাজিক প্রভাব কম নয়। এটি সরকারের বার্ষিক স্বাস্থ্য বাজেটের ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ বা শিক্ষা বাজেটের ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। সেই তুলনায় কর ফাঁকির কারণে ক্ষতি হওয়া ৪ হাজার ২১৮ কোটি টাকা ফাঁকি বন্ধ হলে এই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা হতো। তাতে সরকারের কিছুটা সক্ষমতা বাড়ত।
প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশকে ৩৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের কর থেকে বঞ্চিত করছে; ব্যক্তি খাতে অর্থাৎ বিভিন্ন ব্যক্তির ফাঁকির কারণে ক্ষতি হচ্ছে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর মুনাফা চলে যাচ্ছে ১৪৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
এই ফাঁকির কারণে দেশের বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।
বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত ও বাজেট ব্যয় কম। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, বিশ্বের যেসব দেশে এই অনুপাত সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম।
সে কারণে সরকারের পক্ষে অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। একদিকে কর আইনে নানা ধরনের ফাঁকির সুযোগ থাকায় সামর্থ্যবানেরা ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। ফলে সরকারের সামর্থ্য বাড়ছে না।
ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর ফাঁকির সবচেয়ে অপরাধী হলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। কারণ, বৈশ্বিক উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানির সিংহভাগই এদের মাধ্যমে হয়। তাদের কর ফাঁকির কারণে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়, দেশে দেশে অসমতা বাড়ে। তাদের কারণে স্থানীয় পর্যায়ের ছোট কোম্পানিগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ কর্মসংস্থানের বেশির ভাগই এরা করে থাকে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) তথ্য বিশ্লেষণ করে ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক দেখাচ্ছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রতিবছর যেসব দেশে করের হার কম, সেসব দেশে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার মুনাফা পাচার করছে। তাতে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রত্যক্ষ কর বাবদ বছরে ৩০১ বিলিয়ন বা ৩০ হাজার ১০০ কোটি ডলার হারাচ্ছে।
দেশে দেশে কর ফাঁকি রোধে সরকার যেভাবে করপোরেট করহার হ্রাস করছে, তাতে প্রত্যক্ষ ক্ষতির তিন গুণ বেশি ক্ষতি হচ্ছে বলে গবেষকেরা হিসাব করেছেন। অঙ্ক করলে দেখা যাচ্ছে, এভাবে পরোক্ষ ক্ষতি হচ্ছে বছরে এক লাখ কোটি ডলার।
ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক মনে করছে, প্রতিবছর করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কর ফাঁকির কারণে ক্ষতি হচ্ছে ৪৭২ বিলিয়ন বা ৪৭ হাজার ২০০ কোটি ডলার। ২০৩০ সাল নাগাদ এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে মোট ৪ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার।
এদিকে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দিয়েছে নেটওয়ার্ক। তারা বলছে, বৈশ্বিক অফশোর সম্পদের মধ্যে বাংলাদেশিদের হিস্যা শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, যা দেশের জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ।
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) ফাঁস করা প্যান্ডোরা পেপারস নথিতে দেখা যায়, কীভাবে অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের (বিভিআই) মতো ট্যাক্স হেভেন বা নিম্ন করহারের দেশগুলোয় অর্থ পাঠাচ্ছেন সম্পদশালীরা। এসব স্থানে কোম্পানির মালিকের পরিচয় গোপন রাখা হয়।
আইসিআইজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ধনী ও তারকারা অফশোর ব্যবস্থা ব্যবহার করে প্রমোদতরি ও ব্যক্তিগত জেট ক্রয়, আবাসনে বিনিয়োগ এবং কর কর্মকর্তাদের চোখ এড়িয়ে নিজের ও পরিবারের সম্পদ অন্য দেশে পাচার করেন।
কমেন্ট